একুশে ফেব্রুয়ারিতে এক বাঙ্গালির প্রত্যাশা
রাত ঠিক দুটো
বাজে । একটু আগেই ক্যালেন্ডারে খানিকটা পরিবর্তন আসলো, যা প্রতিদিনই আসে । এই পরিবর্তনেই
দিন যায়, মাস যায়, বছর যায় । একে একে কেটে যায় শতাব্দীর পর শতাব্দী । এইতো গতকালের
দিনটাই আজকে অতীত । সময়ের কী নিষ্ঠুর ব্যবহার ! আমি ইচ্ছে করলেই গতকালে যেতে পারবোনা
।
আমি যখন লিখছি
ততোক্ষণে চারদিকে শহীদ দিবস নিয়ে হৈ চৈ অনেকটাই কমে গিয়েছে । ভোর থেকে আবার সারাদিন
চলবে । কোথাও কোথাও এ উপলক্ষে হয়তো কনসার্টও হয়েছে কিংবা হবে । হোক, তাতে আপত্তি নাই
। নিস্ফল একটা অনুরোধ হৃদয়ে বাংলাকে লালন করলে কনসার্টে বাংলা গানের পরিবর্তে হিন্দি
কিংবা ইংরেজি গান শোভা পেতোনা । তাই বলে বলছিনা এসব গান গাওয়া কিংবা শোনা যাবেনা ।
বিদেশী ভাষার গান শোনেন আর গান, যাই করেন না কেনো, অন্যদিনে করেন, আজকের দিনে না ।
হ্যা প্রতিদিনের
মতো আজকেও আমি নতুন একটা তারিখের সম্মুখীন; শুধু আমি নই পৃথিবীর সব মানুষই আহ্নিক গতির
ব্যবধানে এই তারিখটির সাথে সম্মুখীন হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে । এইতো স্বাভাবিক । রাত তখন
বারোটার কাটা ছুঁইছুঁই । কোত্থেকে যেনো সেই চিরচেনা আর অতি আপন একটা গান ভেসে আসলো
কানে । যতোসম্ভব মাইকে বাজতেছে-
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি,
আমি কি ভুলিতে পারি?...”
গানটা শোনার পর
মনে হলো, ও আজকে না একুশে ফেব্রুয়ারি ! এবার ফের চোখ রাখলাম ক্যালেন্ডারে । নাহ, আজকের
দিনটা প্রতিদিনকার মতো স্বাভাবিক না । আমার জন্য, বাংলাদেশের জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ
একটা স্মরণীয় দিন । ২১ তারিখ হওয়ার কয়েক মিনিট আগেও মনে ছিলো একুশে ফেব্রুয়ারির কথা
। আমি বোধহয় কিছুক্ষণের জন্য ভুলেই গিয়েছিলাম । তাই গানটা শোনার পর সচকিত হলাম । ভেবে
খারাপই লাগলো ।
নিরর্থক ভাষা
দিবস উদযাপন ও বাংলা ভাষার অপ-উচ্চারণরীতি নিয়ে কয়েকদিন আগেই কিছু একটা লিখতে চেয়েছিলাম
। কোনো এক কারণে লিখতে পারিনি ।
দেয়ালে আজ পিঠ
ঠেকে গিয়েছে, আজকে না চাইলেও লিখতে হবে । ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করেও
অন্ততপক্ষে আজ লিখতেই হবে । নইলে যে ঐ পারে তাঁদের কাছে মুখ দেখানোর মতো কিছুই থাকবেনা
আমার এবং আমাদের । কারণ, আমরা যে বাঙ্গালি । তাই সময়ের প্রয়োজনে আমার যে আজ কিছু বলার
আছে ।
না, আজকে আমি
বলতে আসিনি বাংলাদেশের পরতে পরতে যেখানে শহীদ মিনার আছে সেটা ভেঙ্গে ফেলা হোক । আমি
বলতে আসিনি শহীদ মিনারে ফুল দেয়া বেদা’ত কাজ । বলতে আসিনি শহীদ মিনারের সামনে খালি
পায়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা শেরক । আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনে নিরুৎসাহিত করতেও
আসিনি ।
যারা বলে শহীদ
মিনারে ফুল দেয়া বেদা’ত, তারা নিশ্চয় ধর্মের উদ্দেশ্য জানে না । যারা বলে যেখানে শহীদ
মিনার আছে সেটা ভেঙ্গে ফেলা হোক কিংবা শহীদ মিনারের সামনে খালি পায়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে
থাকা শেরক, তারা স্রষ্টার সংজ্ঞা আজও জানে না ।
আপনি যদি মুসলিম
হন, তাহলে শহীদদের জন্য মসজিদে গিয়ে দোয়া করুন । আপনি যদি সনাতনী হন, মন্দিরে গিয়ে
ঈশ্বরের কাছে তাঁদের জন্য প্রার্থনা করুন । আপনি যদি ঈসায়ী হন, চার্চে গিযে ঈশ্বরের
কাছে তাঁদের জন্য প্রার্থনা করুন । এটা স্ব স্ব ধর্মের ধার্মিকদের জন্য প্রযোজ্য; সার্বজনীন
নয় । স্বাভাবিক ভাবেই একজন মুসলিম পারেন না মন্দিরে গিয়ে সনাতনীদের সাথে ভাষাশহীদদের
জন্য পূজা করতে, ঠিক তেমনি একজন সনাতনীও পারেন না মসজিদে গিয়ে মুসলিমদের সাথে দোয়া
করতে ।
কিন্তু একটা দেশে
শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে জাতীয় ঐক্য, কেনোনা এই
ঐক্যই এনে দেবে পারস্পরিক সম্প্রীতি-ভালোবাসা-শ্রদ্ধা । এই ঐক্য হতে হবে একই ভিত্তিতে
হোক সেটা উদ্দেশ্যগত কিংবা সৃষ্টিগত । মানুষ যেহেতু আজও অগণিত চেষ্টা করেও সৃষ্টিগত
ভাবে এক হতে পারিনি তাই আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হলে উদ্দেশ্যগতটাই বেছে নিতে হবে । যদি
উদ্দেশ্যগত ঐক্য বেছে নিই, তাহলে অবশ্যই আমাদের উদ্দেশ্য হতে হবে একস্রষ্টায় বিশ্বাসী
হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা । এখন এটা দেখার বিষয় না যে, সেই স্রষ্টার নাম আল্লাহ না
ভগবান না ঈশ্বর, বরং চিন্তার বিষয় একজন ঈশ্বর কিংবা পরমেশ্বর না হলে রক্তেমাংসে মানুষ
দেখতে একই রকম হতোনা, মানুষ মানুষকে বুঝতোনা ।
যেহেতু দেশের
শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদেরকে এক হতেই হবে, সেই খাতিরেই ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে
একসাথে এক সার্বজনীন রীতিতে অর্থ্যাৎ খালি পায়ে ফুল হাতে শহীদ মিনারে যাওয়া, শহীদদের
শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা পাপ নয়, বরং পুণ্য । যদি কেউ অতি উৎসাহী হয়ে আপনাকে বলে এটা
হিন্দুরীতি, তাকে শুধু একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবনে, শহীদ মিনার নামে সনাতন ধর্মে কোন
দেবতা আছে কিনা? অতি উৎসাহী মুখ নিরুৎসাহিত হয়ে যাবে ।

কেন্দ্রীয় শহীদ
মিনারসহ সারাদেশে শহীদ মিনারগুলো আল্পনা আর ফুলে এতোক্ষণে হয়তো সাজানো শেষ । আমি চাই
আরো অতি আড়ম্বরের সাথে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন হোক । কারণ বাঙ্গালীর সোনার
সন্তানেরা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে । এ ত্যাগ বাঙ্গালীদের এতোটাই বেশি গানটা শুনলেই
অবুঝ মনটা ডুঁকরে ওঠে ।
ইন্টারনেটের বদৌলতে
ফেসবুক আর ব্লগের মাধ্যমে অনেক কিছুই শেখা হয়েছে আর শিখে চলেছি, অনেক কিছু দেখা হয়েছে
আর দেখে চলেছি । কয়েকমাস আগে থেকেই যে জিনিসটা দেখে বেশ অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেছি তা
হলো বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ । যেমন, বিকৃতভাবে ‘আমারে’ শব্দটিকে ‘আম্রে’, ‘তোমারে’
শব্দটিকে ‘তোম্রে’, ‘ব্যাপক’ শব্দটিকে ‘ব্যাফুক’ ‘বিনোদন’ শব্দটিকে ‘বিনুদুন’ ইত্যাদি
বহু শব্দ উচ্চারণ করে চলেছে কিছু উন্নত স্মার্ট ব্যক্তিরা । ইতোমধ্যে আরো লক্ষ্যণীয়,
অনলাইনে এই বিকৃত উচ্চারণগুলোর ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে বাস্তবজীবনেও ব্যবহার
পেয়েই চলেছে, যা প্রমিত বাংলা ভাষা ও ভাষা উচ্চারণের জন্য বিশাল ক্ষতিকারক ।
একুশে ফেব্রুয়ারি
প্রতি বছরই আসে । আমরা দিবসটি পালনও করি । অতি ভালো কথা । কিন্তু দিবসটি যে জন্য সেটাই
যদি ভুলে যাই, তাহলে এই নিরর্থক দিবস পালন করে ভাষা শহীদদের অসম্মান করার কোনো অধিকার
আমাদের নেই । আর উন্নত স্মার্ট ব্যক্তিরা, আপনারা উন্নত স্মার্ট দেশে চলে যান, এইখানে
শহীদ সালাম, জব্বার, বরকত, রফিক, শফিউরেরা চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন । অতি উন্নত স্মার্ট
ব্যক্তিদের জন্য তাঁদের রক্তে রঞ্জিত এদেশের মাটিতে পা রাখার অধিকার দেয়া হয়নি ।
এবারের ভাষা দিবসে
আসুন আমরা সচেতন হই ভাষা দিবসের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য্য নিয়ে । আসুন আমরা ধর্ম-বর্ণ-গোত্র
নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হই আর অসাম্প্রদায়িক বুকট প্রসারণ করে বুকে টেনে নেই সবাইকে, শান্তি
প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বাড়িয়ে দেই সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি-ভালোবাসার হাত । তবেই বাংলাদেশে
ফিরে আসবে প্রকৃত শান্তি । শান্তি প্রতিষ্ঠাই আমার ইবাদত, আর শান্তিই আমার কামিয়াব
।
লেখক
ইলিয়াস আহমেদ
২১শে ফেব্রুয়ারি,
২০১৫
0 comments:
Post a Comment