আমি মফিজ কিংবা ভাটিয়া নই, আমি এলিয়েন
জন্মের পর পরই
প্রতিটা মানবশিশু পৃথিবী সাপেক্ষে একেকটা এলিয়েন বা আগন্তুক । সহজ ভাষায় বলতে গেলে
মেহমান । এলিয়েন এ কারণেই সে এই অদ্ভূত পৃথিবীতে এসে প্রথমে কিছুই ঠাওর করতে পারেনা
। সে কারণেই কি জন্মের পর পর মানবশিশু চিৎকার দিয়ে কান্না করে? হয়তো । ধীরে ধীরে যখন
পৃথিবীর পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে থাকে এরপর থেকে আর সে এলিয়েন থাকেনা, তখন
সে পৃথিবী নামক গ্রহেরই একজন প্রতিনিধি । এটা আমার তত্ত্ব ।

প্রথম দুই তিনদিন
হয়তো আমি ওদের সাথে মিশতে যাইনি । তারপর পরের দিন খেলায় মত্ত মানবশিশুর মধ্য থেকে কে
যেনো আমাকে হাতের ইশারায় ডাকলো । আমি বেশ সংকোচ নিয়ে কাছে গেলাম । সে বললো, আমার গাড়িটা
একটু ঠেলে দাওতো ।
তার কথা শুনে
আমার মনে মনে খুব হাসি পাচ্ছিলো । কারণ ওটা ঠেলে দেয়া লাগেনা । টোকা দিলেই যেটা কয়েকমাইল
গিয়ে পড়বে সেটাতে ঠেলে দেয়া আর ঝড়ের দিনে ফুঁ দেয়া একই কথা । কিন্তু সত্যিকার অর্থে
আমি হাসলামনা । কারণ আমি জানি, সে আমাকে তার খেলার সাথী হওয়ার আমন্ত্রণ জানানোর জন্য
ওটা বলেছে । আমিও বেশ আগ্রহের সাথে গাড়িটা ঠেলে দিলাম । এই প্রথম গাড়িটা হাত লাগার
সাথে সাথে পৃথিবী আমাকে তার প্রতিনিধি বানিয়ে নিলো আর আমি তাকে স্বাগতম জানালাম ।
এভাবে বেশ চলে
যাচ্ছিলো আমার প্রতিটি দিন । কয়েকবছর যেতেই সেই খেলার সাথীদের কে যেনো বললো,
তুই তো স্থানীয়
না !
এতোক্ষণ বেশ মনোযোগসহকারেই
খেলছিলাম । কথাটা শোনার পর হঠাৎ করেই তার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম । আমার এই তাকানোতে
সে বুঝতে পারছিলো আমি স্থানীয় শব্দটির সাথে মোটেই পরিচিত নই । তাই তারা
আমাকে বুঝালো, যারা ঠাকুরগাওয়ে আগে থেকেই আছে তারাই স্থানীয় আর যারা অন্য জায়গা থেকে
এসেছে তারা সবাই বহিরাগত বা অস্থানীয় । আমরা স্থানীয় ।
লক্ষ্য করলাম,
যখন সে বললো, ‘আমরা স্থানীয়’ তখন সে বেশ বুক ফুলিয়ে কথাটা বলছিলো । আমি বুঝলাম না,
এখানে বুক ফুলানোর কী আছে । ভাবলাম কী বোকাই না ওরা ! একে তো সবগুলোই এলিয়েন, তার
উপর কিছুদিন পর সবাই নিজ গ্রহে ফিরে যাবে । আর এরই মাঝে পরভূমে এসে সৃষ্টি করেছে স্থানীয়-অস্থানীয়
শ্রেণীভেদ । কিন্তু এ বুক ফুলানোতে যে যৌক্তিকতা আছে তার প্রমাণ পেলাম কলেজ, ভার্সিটি
পড়ার জন্য যখন বাইরে থাকতে হলো তখন ।
বেশিদিন গেলোনা,
খেলার সাথীদের কাছ থেকে আমি নিজেকে সত্যি সত্যিই ছাড়িয়ে নিলাম । কারণ আমি এলিয়েন হয়েই
থাকতে চাই । এই প্রথম পাড়ার ছেলেমেয়েদের থেকে আমি বহুদূরে যেতে থাকি । আজ যেটা একেবারেই
চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে ।
মাধ্যমিক পাস
করার পর ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে ভর্তি হই । যার কারণে দুইজন বন্ধুসহ শহরের একটা মেসে
উঠি । মেসে উঠার কিছুদিন পর লক্ষ্য করলাম, এখানকার কয়েকজন অনার্স পড়ুয়া বড় ভাই ও সহপাঠীরা
আমাদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করছে । কারণটা জানতে চাইলে পরে তাদের সাথে সরাসরি কথা
বলে যেটা শুনলাম তার জন্য একেবারেই প্রস্তত ছিলাম না । আমার ঐ সহপাঠী বললো, ‘তোরা তো
ভাটিয়া’ । আমি তখনো জানতাম না ভাটিয়া কি জিনিস । তাই তার দিকে অপলকদৃষ্টিতে তাকিয়েই
থাকলাম, যেভাবে তাকিয়ে ছিলাম সেই শৈশবে সেই খেলার সাথীদের দিকে ।
পরে আমার সেই
বন্ধুদের কাছে এসে জানতে পারলাম আমাদেরকে কেনো ভাটিয়া বলে । যারা বৃহত্তর ময়মনসিংহ
থেকে এসে বৃহত্তর দিনাজপুরে বাস করছে তারা সবাই ভাটিয়া । ভাটিয়া শব্দটির সাথে ভাটা
শব্দটির সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত । যাক নতুন একটা পদবী কপালে জুটলো । এরপর থেকে প্রায়
এখনও এই শব্দটা কানে আসে । খারাপ লাগলেও শুনতে হয় । কিন্তু আশ্চর্য্য না হয়ে পারিনি
সেদিন । কেনোনা আমার খেলার সাথীরা না হয় না বুঝেই সেদিন আমাকে স্থানীয়-অস্থানীয় মানদন্ডে
ফেলে দূরে ঠেলে দিয়েছিলো । কিন্তু অনার্সপড়ুয়া ভাইগুলো কী করে পারলো !
সহপাঠীকে আরো
জিজ্ঞেস করেছিলাম কেনো তারা আমাদেরকে দেখতে পারেনা । সে উত্তরটাও যথাযথভাবেই দিয়েছিলো
। ভাটিয়ারা চড়া গলায় কথা বলে, উগ্র মন মেজাজ ইত্যাদি ।
তার কথার যৌক্তিকতা
যে ছিলোনা তা নয়, ঠাকুরগাঁওয়ে যেসব বৃহত্তর ময়মনসিংহ থেকে আগত মানুষ ও পরবর্তী প্রজন্ম,
তাদের বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য । কিন্তু এটাও বিবেচ্য যে, স্থানীয়দের সংখ্যাগরিষ্ঠ
মানুষরই যে মনমেজাজে ভালো, এমনটিও তো না । এটা শুধু ঠাকুরগাঁওয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য
নয়, বাংলাদেশের প্রতিটা জেলা, পৃথিবীর প্রতিটা দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য । এটা কখনই
সম্ভব নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের মনমেজাজ, আচার-আচরণ-সংস্কৃতি একই রকম হবে । অঞ্চলভেদে
বৈচিত্র্যতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক । মানবিক মৌলিকতা ব্যতীত অঞ্চলভিত্তিক বৈচিত্র্যতাকে
যখন সত্য-মিথ্যার মানদন্ডে মাপার চেষ্টা করা হয় তখন থেকেই সৃষ্টি হয় বৈষম্য-বিভেদ ।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, যে খারাপ প্রকৃতির লোক সে সর্বত্রই পরিত্যাজ্য, ঘৃণিত । তার এই
দুষ্টাচারে কেনো স্বগোত্রের নির্দোষ ব্যক্তিটি দোষী হবে? কেনো তার অপরাধের সমস্ত দায়ভার
নির্দোষীর উপর চাপিয়ে দিয়ে তাকে কষ্ট দিতে হবে? যদি এমনই হয় তোমার দৃষ্টিভঙ্গি তবে
তুমি কী করে নিজেকে দেবতুল্য ভাবো?
ভাটিয়া সম্পর্কে
আমার এতোদিন এতোটুকুনই ধারণা ছিলো । বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর একটা সহপাঠীর কথা শোনার
পর আরো আশ্চর্য্য হলাম একারণে যে, সে তো হিন্দুধর্মাবলম্বী । তাকে কেনো ভাটিয়া বলা
হয় ! বোধহয় সেও আমার মতোই…
আমার বাবার পৈত্রিক
ভিটা ছিলো ময়মনসিংহ জেলায় । আশির দশকে গৃহস্থ জমিজমা-পুকুর সব রেখে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসমেত
দাদা ঠাকুরগাঁওয়ে পাড়ি জমায় । এখানে এসে শুরু করেন সংসার । আমার বাপ-চাচার সবাই স্থানীয়
পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করেছেন । যার কারণে আমার মা এখানকার স্থানীয় কিন্তু আমি স্থানীয়
নই ! মা স্থানীয় হওয়াই আমি আঞ্চলিক ভাষার ক্ষেত্রে দোভাষী অর্থ্যাৎ আমি ঠাকুরগাঁও এবং
বৃহত্তর ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষায় সমান সমান কথা বুঝতে ও বলতে পারি । আমার ভাইবোন,
চাচাতো ভাইবোনদের ক্ষেত্রেও একই । ময়মনসিংহ থেকে হঠাৎ করেই ঠাকুরগাওয়ে পাড়ি জমানোর
কারণটা অবশ্য আমি জানতে পেরেছিলাম কিছুদিন আগে দাদার বয়সী একজনের কাছে । তিনিও এখানকার
স্থানীয় নন (প্রচলিত রীতি অনুযায়ী) । উনিও দাদার মতো ঠাকুরগাওয়ে স্ত্রী-পুত্রকন্যা
নিয়ে ঠাকুরগাওয়ে আসেন । তবে উনি আসেন কুমিল্লা-ত্রিপুরা অঞ্চল থেকে ।
গ্রামের রাস্তা
ধরে সেই দাদারবয়সী মানুষটির সাথে হাটতে হাটতে অনেক কিছুই জানলাম । আজকের যে ঠাকুরগাঁওয়ে
সেটা আশির দশকে এতোটা বসতপূর্ণ, বনজঙ্গলবিহীন, আবাদী জমি, যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলোনা
। আমাদের আজকের যে গ্রাম এবং আশেপাশের গ্রামগুলো মূলত একেকটা বিশাল বড় বড় জঙ্গল ছিলো
। বনবিজ্ঞান সম্পর্কে আমার তেমন একটা ধারণা নেই । তবে উনার ভাষ্য অনুযায়ী, আমি যে পথে
আজ হাটছি তার দুপাশে ছিলো বড় বড় উচু টিলা (ছোট পাহাড়েরর মতো), প্রাচীন বড় বড় গাছ আর
জঙ্গলে পরিপূর্ণ । সেই জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দিনের বেলায় মানুষ একা যেতে ভয় করতো । সন্ধ্যা
হলেতো এই রাস্তা ধরে হাটার চিন্তাও করা যেতোনা । ভয়টা ছিলো দুই কারণে । এক, জঙ্গলে
মাঝে মাঝেই পাওয়া যেতো বাঘ । আর মানুষখেকো শিয়ালের সংখ্যা এবং তাদের উপদ্রব এতোটাই
বেশি ছিলো যে, দিনদুপুরে গৃহস্থ বাড়ি থেকে কয়েকটা শিয়াল এসে গৃহপালিত পশুপাখিকে ধরে
নিয়ে যেতো । শুধু পশুপাখি নয়, ছোট ছোট শিশুকে ধরে নিয়ে গিয়েছে । সেই জঙ্গলের ভিতর দিয়ে
যেতে গিয়ে ভয় পাওয়ার আরেকটা কারণ হলো ভুত-পেত্নীর ভয় । যে অঞ্চল বনের ন্যায় জঙ্গলে
বেষ্টিত আর হিংস্র প্রাণীতে পরিপূর্ণ, সেই
অঞ্চলের মানুষগুলোর মনে এই ভয়টা থাকা একেবারেই স্বাভাবিক ।
না, আজকে আর ঠাকুরগাওয়ের
গ্রামগুলো এমন নয় । বাঘ আর বন-জঙ্গলের নিশানাও নেই । আমাদের পাশ্ববর্তী কয়েকটা গ্রামে
শিয়ালের উপদ্রব কিছুটা থাকলেও তা একেবারেই কম । যে গ্রামে বৃহৎ পরিমাণে আঁখের চাষ হয়
সেই অঞ্চলে শিয়ালের উপদ্রবটা লক্ষ্যণীয় ।
অথচ বাংলাদেশের
অনেক অঞ্চলের বিশেষ করে নোয়াখালী-লক্ষীপুর-ফেনী-কুমিল্লার যারা সেই সময়ে ঠাকুরগাঁওয়ে
এসেছিলো, তারা আজও জেনে আসছে ঠাকুরগাঁও নাকি একটা বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ জেলা ।
দাদারবয়সী মানুষটার
সাথে হেঁটে চলেছি । আমার নিজের দাদাকে স্বচক্ষে দেখিনি । তিনি ঠাকুরগাওয়ে এসেই কিছুদিনের
মধ্যে মারা যান । যার ফলে আমার নিজের ছোট চাচা উনাকে স্মরণ রাখতে পারেন নি দাদু দেখতে
কেমন ছিলো ।
দাদার বয়সী মানুষগুলো
দেখলেই নিজের দাদা মনে হয় । সে কারণেই যাঁর সাথে গল্প করে চলেছি উনাকে আপন মনে করেই
একের পর এক জিজ্ঞেস করে চলেছি । উনিও বেশ আগ্রহ সহকারে বলে যাচ্ছেন ।
আমি বললাম, আপনারা
এখানে মানে ঠাকুরগাঁওয়ে কেনো এসেছেন?
আমার প্রশ্ন শুনে
উনি হেসে দিলেন । তিনি বললেন, আমরা যেখানে আগে থাকতাম সেখানের দু-এক জন সর্বপ্রথম ঠাকুরগাঁওয়ে
এমনি বেড়াতে আসে । এখানে এসে দেখে, এখানকার জমিজমার দাম নেই বললেই চলে । তার উপর যতো
জমি আছে সব পড়ে আছে । আবাদ করার মতো লোকও নেই । আর ভয়ে কেউ বনজঙ্গল কেটে চাষাবাদ করতে
চাইতোনা । তাই বলে এখানকার মানুষ না খেয়ে থাকতো তেমনটিও না । যা উৎপন্ন হতো তা দিয়ে
অনায়াসেই রাজার হালে দিন কেটে যেতো সবার । যখন অন্য অঞ্চলের মানুষ যারা জানতে পারলো
এখানের পরিবেশের এই অবস্থা তাদের অনেকেই জমিজমা বিক্রি করে এখানে আসতে লাগলো । এসে
বনজঙ্গল কেটে প্রথমে ঘর উঠালো তারপর আবাদী জমি । যে জমিতে আগে বছরে একটা ফসল উৎপন্ন
হতো সেই জমিতে আমরা এসে দু তিনটা ফসল উৎপন্ন করি । আমরা যখন এখানে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস
শুরু করলাম, তখন আমাদের দেখাদেখি আমাদের আত্মীয় স্বজন ও আগের পাড়া প্রতিবেশীরাও এসে
এখানে ঘর উঠালো । এইতো এভাবে একের পর একেকটা পরিবার, সংসার বৃদ্ধির কারণে আমাদের গ্রামসহ
পার্শবর্তী কয়েকটা গ্রামে বাইরের অঞ্চলের মানুষদের বসতিতে ধীরে ধীরে আজকের এই অবস্থা
। অবস্থা এই হয়েছে যে, আজ স্থানীয়দের চেয়ে বহিরগাতদের সংখ্যাটাই বেশি ।
যাক, এ ব্যাপারে
আর এগুলাম না । এতো জেনে কী লাভ ! কে কিভাবে এখানে আসলো, না ঘর বাধলো, না কী করলো তাতে
কী আসে যায় ! সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমরা এখানে অস্থানীয় এবং পদবীতে আমরা ভাটিয়া ! তাই
দাদার বয়সী মানুষটার সাথে এ ব্যাপারে আর দ্বিতীয়বার কিছু জিজ্ঞেস করলাম না ।
ক্লাস নাইন-টেনে
পড়াকালীন একটা শব্দের সাথে পরিচিত হই । শব্দটার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয় যে, সে
তখন প্রায় ঢাকায় যাওয়া আসা করতো । আমার তখনো ঢাকায় যাওয়া হয়নি । তাই ঢাকার গল্প শুনতে
তার সাথে গল্প করতাম । সে বার সে বললো, আমাদের এদিকের মানুষগুলোকে ঢাকা-গাজীপুরের ঐদিকে
নাকি মফিজ বলে ডাকে । আমি তাকে বললাম, এটা আবার কেমন কথা ! মফিজ তো একটা মানুষের নাম
। কারণ জানতে চাইলে সে বললো, এইদিকের মানুষগুলো বোকা এজন্য মফিজ বলে ডাকে ।
তখন পর্যন্ত মফিজ
সম্পর্কে আমার ততোটুকুনই ধারণা । ধারণার পরিধি বাড়ে কয়েক বছর পর যখন থেকে আমি ঢাকায়
আসা যাওয়া শুরু করি, দেশের আঞ্চলিক পরিসংখ্যান নিয়ে একটু আধটু ঘাটাঘাটি করি । পরে বুঝতে
পারলাম রংপুর বিভাগের বিশেষ করে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলটি মঙ্গাপীড়িত । জাতীয় পর্যায়ে
অবহেলিত হওয়ার কারণে সারাবাংলাদেশে যতোগুলো বিভাগওয়ারী দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারীর
হার রয়েছে তন্মধ্যে রংপুরে দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারীর হার সবচেয়ে বেশি । বেশিরভাগ
মানুষ কৃষির উপর নির্ভরশীলতা এবং নদীবাঁধ ও নদীব্যবস্থা প্রতিকূলে থাকাটাই এখানকার
অঞ্চল মঙ্গাপীড়িত হওয়ার অন্যতম কারণ । একদিকে প্রতিকূল অবস্থায় ধান চাষ আর অন্যদিকে
ফসলের মূল্য হ্রাস দুটোই একজন কৃষকের জন্য অবশ্যই সুখবর নয় । এদেশে পর্যাপ্ত ধান-গম
থাকলেও পূর্বোক্ত চুক্তি অনুযায়ী বাইরের দেশ থেকে ধান-গম আমদানী করতে হয়, কিন্তু কখনোই
মাছ আমদানী করতে হয় না । ফলে একজন ধান চাষীর ক্ষতির যে সম্ভাবনা থাকে সেই ক্ষতির সম্ভাবনা
কিন্তু একজন মাছচাষীর থাকেনা, বরং রপ্তানী বাজারে মাছ চাষ সর্বদাই সামনের কাতারে ।
উত্তরবঙ্গ অপেক্ষাকৃত উঁচু ও শুষ্কময় হওয়ার কারণে এখানে মাছ চাষের সম্ভাবনা একেবারেই
কম । কিন্তু চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল বিভাগে খুব একটা আবাদী জমি নেই বললেই চলে । সেখানে
মানুষদের পেশায় আছে যেমন বৈচিত্র্যতা, তেমনি সেখানকার মাছচাষীরা সর্বদাই সফল । সিলেট
বিভাগে আছে চা চাষ আর জনশক্তি রপ্তানীতে বিশাল
খাত । আর ঢাকা ও ঢাকা বিভাগ নিয়ে বেশি কিছু বলার প্রয়োজনই নেই । একদিকে সারাদেশের কেন্দ্রীয়
সুবিধা আর অন্যদিকে সমস্ত শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে ঢাকা ও ঢাকার পাশ্ববর্তী জেলাগুলোতে
। একমাত্র রংপুর বিভাগ এসমস্তের কোনোটাতেই নেই । তাহলে রংপুর বিভাগ সবার থেকে পিছিয়ে
থাকবেনা কেনো?
মনে হয় একটু বেশিই
অপ্রাসঙ্গিক বলে ফেলেছি । মফিজ নিয়ে বলতে গিয়ে শেষ থামলাম রংপুর বিভাগের উন্নয়ন আলোচনায়
। কিন্তু এছাড়া আমার যে উপায়ও নেই । আপনিই বলুন কারই বা ইচ্ছে করে তাকে এবং তার অঞ্চলের
মানুষগুলোকে শুধুমাত্র দারিদ্র্যতার কারণে এমন কিছু বলুক যাতে মনে কষ্ট পায়, নিজেকে
ছোট ভাবে ।
গতকাল আমার খুব
ভালো একটা বন্ধু আমার মনটা খারাপ করে দিয়েছে একটা শব্দ উচ্চারণ করে । তাদের বাসা গাজীপুরে
। কথা বলতে বলতে সে একসময় বললো, তোমাদের দিকের মানুষগুলোকে আমরা কী বলে ডাকি জানো?
আমিতো জানতাম কী বলে আর ডাকবে ! তবুও বললাম, কী? সে বললো, মফিজ । আমি জানতাম এটাই তার
উত্তর । আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে তো আমিও মফিজ? সে হাসতে হাসতে বললো, হ্যা ।
হাস্যরসেই হোক
আর স্বাভাবিক ভাবেই হোক, সে তো সত্যটাই বলেছে । আমরা তো মফিজই । আমরা কি আর মানুষ?
মফিজই আমাদের আসল পরিচয়, মানুষ নয় । পরিচয় যদি মানুষই হতো, সবার আগে গুরুত্ব পেতো আমরা
মানুষ ।
আমি আজ খুব ভালো
করে বুঝতে পারছি আমি সত্যিই একটা এলিয়েন । জন্মের পর থেকেই শিখেছি ঠাকুরগাঁওয়ে আমার
মা স্থানীয় কিন্তু আমি নই । সাবু-হাবুরা এখানে জন্ম নেয়ার সাথে সাথেই স্থানীয়তার সার্টিফিকেট
পেয়ে যায়, কিন্তু আমি এখানে জন্মালে সেটা তো পাইনা তার উপর কপালে ‘ভাটিয়া’ সীল লাগিয়ে
দেয়া হয় ।
নিজের জেলার বাইরে
গেলেই মাথানিচু করে হাটতে হবে । কারণ আমি সেখানে অস্থানীয় । স্থানীয়দের সামনে মাথা
তুলে হাটার অধিকার আমাকে কে দিয়েছে?
আজ আর আমি এসব
ভেবে মন খারাপ করিনা । কারণ আমি তো নিজেকে সেই ছোটবেলা থেকেই এলিয়েন ভেবে আসছি । এখন
তো সেটা পাকাপোক্ত হলো আর কি ! আমি এই পৃথিবীর কেউ না, এখানে আমার কেউ নেই ।
লেখক
ইলিয়াস আহমেদ
0 comments:
Post a Comment