আমি মানুষ হইবো কেনো?

করিতে হইয়াছে তাহার কোনো হিসাব মিলিবে না। এতসব কাঠখড় পোড়াইয়া তবেই না আমি বড় ডিগ্রিধারী চিকিৎসক হইয়াছি। পিতা আর শুভাকাঙ্খী আত্মীয়- স্বজনেরা স্বচক্ষে দেখিয়া আসিতেছে ‘চিকিৎসা সেবা’
ব্যবসাটি বর্তমান সময়ে বিশেষ লাভজনক আবার সম্মান জনকও বটে। সেই দিকটা বিবেচনা করিয়াই আমার পেছনে দু’হাত ভরে খরচ করিয়া তাঁহারা আজ একেবারে নিঃস্ব হইয়া আসিয়াছে। আমি ইবনে সিনা নই, হাজী মোহাম্মদ মহসীনও নই। আগে পিতার টাকার ঝুলিটা পূরণ করিতে হইবে অতঃপর নিজেরটা। তারপরেই না হয় ভাবিব কী করিয়া বিনামূল্যে চিকিৎসায় মানবসেবা করা যায়! সেই জন্যইতো সরকারি হাসপাতালের
চাইতে ক্লিনিকের, বিনা পয়সার রোগীদের চাইতে পার্সোনাল চেম্বারের রোগীদের কদর বেশি। ইহা না করিতে পারিলে কী আর এতদিনের আশা আকাক্সক্ষা পূরণ করিতে পারিব? জমি বিক্রি করিয়াছি, ব্যাংক থেকে চড়াসুদে ঋণ লইয়াছি, অতঃপর নির্বাচনের প্রচারণা চালাইয়াছি। পাড়ায়-মহল্লায় নিজের পদপ্রার্থিতা উপলক্ষ্যে মিছিল-মিটিং-এর ব্যবস্থা করিয়াছি। নির্বাচনে জয় পাবার নিমিত্ত আমি কোটি কোটি টাকা ক্ষয় করিয়াছি।
তা না হলে কেহ যে আমাকে ভোট দিয়া জয়যুক্ত করিবে না, তা আমি যতই সৎ হই না কেন। দিনের পর দিন ভাষণে বলিয়াছি, ‘সংগ্রামী ভাই ও বোনেরা, আমাকে জয়যুক্ত করিলে আপনাদের সেবা করিয়া কৃতার্থ হইব’ আর রাতের আঁধারে বড় বড় নোট দেখাইয়া ভোট কিনিয়াছি। নূতন পাঁচশ’ টাকার নোট দেখিয়া তোমাদিগরও জিহ্বা লোভে লক লক করিয়া ছিল। আমাকে বোকা পাইয়াছ? দুর্নীতি করিয়া লাভসহ মূলধন উঠাইব না- তো কী করিব? ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেইদিন হইতে যাতায়াত শুরু করিয়াছিলাম, সেইদিনই ধর্মীয় ওস্তাদ (!) আমাকে শিখাইয়াছেন কী করিয়া ধর্মের বাণী শুনাইয়া লোকের নিকট হইতে টাকা খসাইতে হয়। তিনি আমাকে ইহা শিখান নাই ধর্মের বিনিময়ে অর্থগ্রহণ করিলে ইহা আর ধর্মীয় কাজ থাকে না, হইয়া যায় ধর্মব্যবসা। রুজি-রোজগারের ব্যাপারে ধর্মব্যবসা ব্যতীত বিকল্প যে কোনো উত্তম ব্যবস্থা থাকিতে পারে ইহা তো আমাকে শেখানো হয় নাই। কোনো ওস্তাদই (!) আমাদিগকে ইহা ভুলক্রমেও শিখান নাই যে ধর্মের উদ্দেশ্য-লক্ষ্য শুধুমাত্র মানব কল্যাণ। তিনি স্বপ্ন দেখাইয়াছেন মসজিদের ইমাম হইয়া, নামায পড়াইয়া, মিলাদ পড়াইয়া, জানাজা পড়াইয়া, ধর্মের কাজ করিয়া কীভাবে সংসার চালাইতে হয়। কী করিয়া ওয়াজ করিলে হাজরো মানুষের চোখ ভিজিয়া যায় আর পকেট উজার করিয়া তাহারা অর্থ প্রদান করে তাহা অতি উত্তমরূপে শিখিয়াছি। এখন আপনরাই বলুন, ধর্মের বিনিময়ে আমি টাকা লইব না- তো করিবটা কী? আজিকার দিনে শিক্ষা, চিকিৎসা, শাসন, ধর্ম ইত্যাদি কোনো বিষয়ই আর সেবা বলিয়া গণ্য হইয়া থাকে না। আর যেথায় নিঃস্বার্থ সেবা পেশায় পরিণত হয় সেথায় আমি মানুষ হইব কেন? আমি শান্তির আশা করিব কেন? আমার কথা তো অনেক শুনাইলাম। শেষ করিবার. পূর্বে সক্রেটিসের একটি বানী শুনাইব। তিনি একদা বলিয়াছিলেন, ‘অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা অর্জনের চাইতে অশিক্ষিত. থাকাই উত্তম’।
কসম স্রষ্টার! কঠিন হিসেব তোমাদিগের দিতে হইবে, যে হিসেব দিতে হইবে না একজন বর্গাচাষী কৃষকের, কুলিমজুরের বা ওই দিনমজুরের।
লেখক
ইলিয়াস আহমেদ
0 comments:
Post a Comment