স্বপ্ন দ্যাখো, স্বপ্ন দ্যাখাও হে ভারতবর্ষ
![]() |
এই বৃদ্ধ লোকটির নিক্ষিপ্ত ফলটি ওপারের মানুষটি পাবেতো? |
ফরমাল বা অফিসিয়াল ড্রেস বলতে আমরা আজকে যা জানি কয়েক শতাব্দী আগে এদেশের মানুষতো জানতোইনা, সমগ্র ভারতবর্ষ তার নামও শুনেনি । ব্রিটিশরা যেদিন থেকে ভারতবর্ষকে শাসন করতে শুরু করলো, তারা এ উপমহাদেশের মানুষকে বুঝাতে সক্ষম হলো যে তারাই পৃথিবীর একমাত্র উন্নত জাতি! সেটা উচ্চ করারোপের মাধ্যমেই হোক, জোরপূর্বক নীলচাষে কৃষকদের বাধ্য করেই হোক, জমিদার প্রথা সৃষ্টি করেই হোক, ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভাজন করেই হোক, তাদের দেয়া শিক্ষানীতি চাপিয়ে দিয়েই হোক, ভারতবর্ষে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেই হোক আর এ উপমহাদেশের কাঁচামাল ও ধনসম্পদ ইউরোপ মহাদেশে পাচার করেই হোক অর্থ্যাৎ যতো অন্যায় করেই হোক ব্রিটিশরা শেষ পর্যন্ত প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে, তারাই একমাত্র উন্নত জাতিই শুধু নয়, একমাত্র পরাশক্তিধর জাতি । তারা বাদে আর যতো জাতি আছে কেউ জঙ্গী জাতি, কেউ বর্বর জাতি, কেউ অনগ্রসর জাতি, কেউ হামুখো বাঙ্গালী জাতি !
ভারতবর্ষে শাসনের সুবিধার্থে ব্রিটিশরা এদেশের সেই সব শিক্ষিত শ্রেণীটিকে গ্রহণ করলো যারা ইতোমধ্যে ব্রিটিশদেরই চাপিয়ে দেয়া আত্মাহীন সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত হয়েছে । সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ব্রিটিশরা আরো একটি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করলো, মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা । কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসা (আজকে যেটি আলীয়া বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠা করে তাদের মনগড়া সিলেবাস ও ইসলাম শিখিয়ে ব্রিটিশরা আরেক শিক্ষিত শ্রেণীর জন্ম দিলো, যারা শিক্ষাদীক্ষায় সাধারণ শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত । এবং এ শিক্ষাব্যবস্থায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি রাখাই হলোনা যাতে করে, এ শিক্ষিত শ্রেণীটি অন্যান্যদের মতো রোজগার করে খেতে না পারে । যে ইসলাম শেখানো হলো তা ফতোয়াবাজী, কোরআন-হাদিসের ব্যাখ্যায় পরিপূর্ণ, যা কেবল মতানৈক্যের সৃষ্টি করে, ঐক্যবদ্ধজাতিতে অনৈক্য সৃষ্টি করে । একদিকে কেরানীমার্কাধারী শিক্ষিত শ্রেণী যাদেরকে শেখানো হলোনা ধর্মীয় নীতিবোধ, যাদের মাঝে না আছে ধর্মীয় জ্ঞান আর অপরদিকে কথিক আলেম শ্রেণীটি, যাদের মাঝে আছে কেবলমাত্র ধর্মীয় জ্ঞান । স্বভাবতই প্রথম শ্রেণীটি ব্রিটিশ পা চাটা গোলামের পারদর্শীতা অর্জন করলো আর দ্বিতীয় শ্রেণীটি ঝুকেঁ পড়লো ধর্মব্যবসার মধ্যে । বিকৃত ইসলাম শিক্ষিত শ্রেণীটি আর সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণীটির পরস্পর বিরোধী অবস্থান নেয়ার কারণে এই প্রথম জন্ম নিতে শুরু করলো জাতির মধ্যে অনৈক্য ।
প্রথম দিকে হিন্দুরা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে বিভিন্ন সরকারি অফিস আদালতে চাকুরীর সুযোগ পায় আর ব্রিটিশদের মনোবাসনাই ছিলো একসময়ের পাল,মৌর্য,গুপ্ত,শাহ, মুঘল, প্রভৃত রাজ-রাজাদের উত্তরসূরীদেরকে কেরাণি বানিয়ে ইচ্ছামতো পায়ের নিচে পিষবে । তাদের এই মনোবাসনা পূরণও হয়েছিলো । দাউদ কররাণীর পরবর্তী সকল নবাব রাজাদের ক্ষেত্রে এই হয়েছিলো যে, কেউ নামে মাত্র নবাব বা রাজা, কেউ মদতপুষ্ট । সর্বশেষ নবাব সিরাজদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে ব্রিটিশরা তাদের সিদ্ধ লাভ করে ।
জমিদারি প্রথার শেষের দিকে এ উপমহাদেশের অফিস আদালতে স্বদেশীরা চাকুরীর সুযোগ পায় । ব্রিটিশদের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরে পরিণত হয়ে ভাবেন, এ উপমহাদেশের ছেলেমেয়েরা এতো অলস কেনো? তাদের সিলেবাসে আরো বই চাপিয়ে দেয়া উচিৎ, পিছিয়ে পড়ছে প্রজন্ম! কিন্তু সেদিনের বিদ্যাসাগর কি এতোটুকুনো ভাবলেন না যে, সবাই তার মতো বিদ্যাসাগর না, সবার শিক্ষা ধারণ ক্ষমতাও এক না? সেদিনের বিদ্যাসাগরের মনে এ প্রশ্নের উদয় না হলেও তাঁর মতো না হোক, কাছাকাছি বর্তমান প্রজন্মের বিদ্যাসাগর মুহাম্মদ জাফর ইকবাল স্যারেরা শেষ পর্যন্ত ঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছেন, আর যাই হোক, এভাবে বইয়ের সংখ্যা বাড়িয়ে গেলে উত্তরোত্তর প্রজন্ম বইয়ের ভার বইতে না পেরে নুইয়ে পড়বে; ভেঙ্গে যাবে জাতির মেরুদন্ড ।
ঈশ্বরচন্দ্রের ন্যায় নওয়াব আব্দুল লতিফ, স্যার সৈয়দ আমীর আলীও যথেষ্ট চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন কী করে মুখ থুবড়ে পড়া জাতিটিকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে একটা কেরানীপেশার চাকুরী হাতে ধরিয়ে দিয়ে উন্নত করা যায়, যদিও মুখ থুবড়ে পড়ার পিছনে কেবলমাত্র ইংরেজদের কুশাসনই দায়ী! আসলেই কি তাদের এই প্রচেষ্টা ভারতবর্ষের জাতিটিকে উন্নত করতে পেরেছিলো? দাস জাতিটিকে মুক্ত না করে ইংরেজদের আদালে গড়তেই স্বপ্ন দেখতো তৎকালীন ভারতবর্ষের বুদ্ধিজীবীরা । অবশ্য এটাই স্বাভাবিক ছিলো । কারণ তারাতো সবাই ইংরেজদের শিক্ষানীতিতে শিক্ষিত!
আজকের ভারতবর্ষ একসময় ছিলো ধনসম্পদে ভরপুর, অভাবহীন শান্তিময়, সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্যপূর্ণ জাতির মেলবন্ধন । ভারতবর্ষের পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো ঐশ্বর্য্য, সংস্কৃতির লীলারূপ । সেই লীলারূপে মোহিত হয়ে এখানেই স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেছিলো আরব-পারস্যের মুসলিম জাতিটি । তারা এখানে এসে এ উপমহাদেশের সংস্কৃতি রক্তে মেখেছিলো । কিছুদিন আগেও মুসলিমদের নামের আগে শ্রী যুক্ত করতে তাদের কুন্ঠাবোধ জাগেনি । এ উপমহাদেশে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমরা হিজাব খুলে শাড়ি পরেছে, জোব্বা-পাঞ্জাবী খুলে লুঙ্গি-ধুতি-ফতুয়া পরেছে । এদেশেরই নারী-পুরুষদের করেছে জীবনসঙ্গিনী, এদেশে থেকেই তারা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে । আরব্যরজনীর উপন্যাসের চেয়ে তাদের ছেলে মেয়ের কাছে প্রাধান্য পেয়েছে ঠাকুমার ঝুলির মতো এ উপমহাদেশের মজার মজার গল্পগুলো । ভারতবর্ষেতো আরো অনেক জাতিই এসেছিলো বাণিজ্য করতে । বাণিজ্য করতে এসে তারা কী করেছে তা ইতিহাসে লেখা থাকলেও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে আজ ব্রিটিশরাই সমাদৃত ! অথচ ব্রিটিশরা এ উপমহাদেশে এসে লুটপাট-স্বৈরাচারী শাসন-চাবুক পেটানো ছাড়াও অতিরিক্ত যা করেছে তা হলো, তারা এ উপমহাদেশের সংস্কৃতিকে তো মেনেই নেয়নি তার উপর ইউরোপের সংস্কৃতি ভারতবর্ষের বাঙ্গালীসহ অন্যান্য জাতিগুলোর উপর চাপিয়ে দিয়েছিলো সুকৌশলে । সুকৌশলে বলার কারণ এজন্যই যে, তখন ইংরেজি ভাষা শেখা, ধুতি-পাঞ্জাবী ছেড়ে বিলেতি পোষাক (আজকের ফরমাল ড্রেস) ছাড়া সরকারী চাকুরী জুটতোনা । এভাবেই তারা তাদের সংস্কৃতির কৃত্রিম প্রয়োজনীয়তার সৃষ্টি করে, পরবর্তীতে যেটা কাস্টম হয়ে দাঁড়ায়, যা আজ এতোটাই বেসম্ভব জনপ্রিয় পেয়েছে যে, অফিস-আদালত-হাসপাতাল-বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এর বিপরীতে ধুতি-লুঙ্গি-পাঞ্জাবী পড়লে নিজেকে সাংস্কৃতিক জোকার মনে হয়, ইংরেজিতে আমরা যাকে বলি ‘Uncultured’ . একসময়ে যে পোষাক প’রে রাজ্য পরিচালনা করতো সেই জাতি কিনা পরগাছা হয়ে একদিকে অন্যজাতিকে অন্ধভাবে অনুসরণ করছে আর অন্যদিকে নিজেকে হীনজাতি, নীচ, অনগ্রসর, অলস ইত্যাদি বলে গালি দিচ্ছে । ভারতবর্ষের কি নির্মম ইতিহাস ! তাই শুরুর দিকে এ প্রসঙ্গটাই টেনে এনেছিলাম ।
ব্রিটিশরা এ উপমহাদেশের সম্পদের লোভে বাণিজ্য করতে এসেছিলো, আরবজাতিটির মতো স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য নয় । সমগ্র ভারতবর্ষে হাতে গোনা কয়েকজন ইউরোপিয়ানের কবর পাওয়া যেতে পারে যারা ব্রিটিশ শাসনকরাকালীন এখানে মৃত্যুবরণ করেছিলো । অপরপক্ষে এ উপমহাদেশে আগত আরবজাতিটির ইতিহাস তার তুলনায় কতগুণ বেশি ! কয়জন ব্রিটিশ এ উপমহাদেশের নারী কিংবা পুরুষকে বিয়ে করেছে, জীবনসঙ্গী করেছে? বিয়ে করার প্রশ্নই আসেনা । যাদেরকে চাবুকের প্রহারে শিশু থেকে বৃদ্ধতে পরিণত করেছে, যাদেরকে পায়ের তলে রেখেছে তাদেরকে হঠাৎ করে বুকে টেনে নেয়া নিতান্তই বোকামি । নীলকুঠিগুলো যেনো আজও সাক্ষী দেয়, এখানে কয়েকবছর ধরে হাজারও ভুখা কৃষককে ‘লাগান’ বা ‘খাজনা’র জন্য বন্দি রাখা হয়েছিলো, চাবুক দিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিলো, তাদের স্ত্রী-কন্যার সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে সেই খাজনা আদায় করা হয়েছিলো !
ব্রিটিশরা এ উপমহাদেশের কৃষকদের রক্ত দিয়ে ইউরোপে গড়ে তুলেছিলো বড় বড় শিল্পকারখানাগুলো । তাদেরই ভ্রান্তনীতির কারণে এ উপমহাদেশে একাধিক দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিলো । ১৮৭৬ সাল থেকে শুরু ১৮৭৮সাল পর্যন্ত দুইবছরব্যাপী দুর্ভিক্ষে এ উপমহাদেশে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬১,০০০,০০ থেকে ১০৩,০০০,০০ জন (রিপোর্টঃ Late Victorian Holocausts. 1. Verso, 2000. ISBN 1-85984-739-0 pg 7, Written by Davis, Mike.) আর তার মাত্র ২১ বছরের মাথায় অর্থ্যাৎ ১৮৯৯ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে আবারো দুর্ভিক্ষে পড়ে ভারতবর্ষ । এটাকে ভারতীয় মন্বন্তর বলা হয় । এই দুর্ভিক্ষে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২৫,০০০,০০ থেকে ১০০,০০ জন । (রিপোর্টঃ Reintegrating India with the World Economy, Peterson Institute for International Economics, Wikipedia).
ব্রিটিশরা শুধু এটুকুন করেই ক্ষান্ত হয়নি । তারা এ উপমহাদেশে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন সৃষ্টি করে । ভারতবর্ষের ভাইসরয় লর্ড কার্জনের নির্দেশে সর্বপ্রথম ১৯০৫ সালের ১৬ ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ অর্থ্যাৎ বাংলা বিভাজন হয় । বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে ১৯০৬ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক হৃদয়স্পর্শী সঙ্গীত “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” রচনা করেন, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হয় । ১৯১১ সালের প্রচন্ড গণআন্দোলনের তোপের মুখে পড়ে বঙ্গভঙ্গ রহিত করতে বাধ্য হয় ভাইসরয় । যেহেতু ব্রিটিশদের শাসন করার নীতিই ছিলো ‘বিভক্তি ও শাসন’ (Divide & Rule) নীতি, স্বভাবতই ১৯৪৭ সালে তারা বাংলা প্রদেশকে চূড়ান্ত বিভক্তি করলো । ভারত ও পাকিস্তানের বিভক্তি রেখার নামই রাখলো ‘র্যাডক্লিফ লাইন’ । এই ‘র্যাডক্লিফ লাইন’ কি ঘিরে ভারতবর্ষে কতইনা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি হয়েছে । রেডক্লিফ লাইনেরর এ পারের মানুষ ওপারের মানুষকে ঘৃণা করতে শুরু করলো, ওপারের মানুষ এ পারের মানুষকে । কাঁটাতারবিহীন একসময়ের ভারতবর্ষ আজকের দিনে যে যার মতো সীমান্তে গুলি করে মারছে তারই একসময়ের প্রাণের ভাইবোনকে । ধর্মের ভিত্তিতের ভারত বিভাজনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জলজ্যান্ত প্রমাণ আজকের জম্মু-কাশ্মীর, যার কোনো সুরাহাই মিলছেনা, লাশের পর লাশের বন্যায় ভিজেছে এ দুটো অঞ্চল ।
বারবার চাপের মুখেও পড়ে ব্রিটিশরা শেষ পর্যন্ত যেকারণে ‘বিভাজন ও শাসন’ (Divide & Rule)নীতিতে বিশ্বাসী ছিলো, তা হলো, ইতোমধ্যেই তারা দেখেছিলো এ উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অভাবনীয় । আর এই ব্রিটিশবিরোধী ঐক্যেবদ্ধ আন্দোলনের কাছে তাদের কামান-গোলা-চাবুকের গুরুত্বই নেই । ফকির-সন্নাসী-ফরায়েজী আন্দোলনে তাদের বুক কেঁপে উঠেছিলো । ভারতবর্ষকে দ্বিখন্ডিত করতে গেলে ব্রিটিশরা বারবার চাপের মুখে পড়ে । এ উপমহাদেশের মানুষ সাম্প্রদায়িক বিভাজন চায়নি । চায়নি রবীন্দ্রনাথ, চায়নি নজরুল । নজরূল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লিখেছিলো যুগবাণী, বিষের বাঁশী, ভাঙ্গার গান, প্রলয় শিখা, চন্দ্রবিন্দুর মতো গ্রন্থ যা যথাক্রমে ১৯২২,১৯২৪,১৯২৪,১৯৩১,১৯৩১ সালে বাজেয়াপ্ত করে ব্রিটিশ সরকার । অগ্নিবীণা, সর্বহারা, রুদ্রমঙ্গল সহ আরো অনেক বই তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়ে এবং বাজেয়াপ্ত বইগুলোসহ এই বইগুলো কারো কাছে রাখা গুরুতর অপরাধ ছিলো । তৎকালীন পুলিশ কর্তা স্যার চার্লস টেগার্ট এবং ব্রিটিশদের তৈরী করা শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত তৎকালীন পাবলিক প্রসিকিউটর রায়বাহাদুর তারকানাথ সাধু সর্বহারা’ বইটি নজরুলের ‘নিষিদ্ধ করার পে মতামত দেন, যদিও তাদের সুপারিশে ইংরেজ সরকার বইটি শেষ পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত করেন নি । প্রসিকিউটর রায়বাহাদুর তারকানাথ সাধুদের মতো দেশীয় প্রায় বেশিরভাগের অন্তরাত্মায় অসাধু, ব্রিটিশদের চাটুকারিতা, দাসত্ব বেশ ভালো করেই ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয় ব্রিটিশ শিক্ষানীতি ।
বঙ্গভঙ্গের পূর্বে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা প্রদেশেরই অন্তর্ভূক্ত ছিলো, বঙ্গভঙ্গের কারণে যা পরবর্তীতে ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয় । উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালের বঙ্গভঙ্গটি ছিলো ধর্মের ভিত্তিতে । পশ্চিমবঙ্গ হিন্দু প্রধান হওয়ার কারণে তাকে হিন্দু প্রধান রাষ্ট্র ভারতে সংযুক্ত এবং বাংলা প্রদেশে মুসলিমদের সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র পাকিস্তানে অন্তর্ভূক্ত করা হয় । প্রাদৈশিক শাসনের সুবিধার্থে পাকিস্তানকে আবারো দুই ভাগে ভাগ করা হয়, পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান । পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব থেকেই ব্রিটিশদের একচোখা নীতির কারণে পাকিস্তানে একচ্ছত্র রাজ্য বিস্তার করে এবং বঙ্গভঙ্গের ফলে নব্য সংযুক্ত বাংলা প্রদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তান অনেক পিছিয়ে পড়ে । ব্রিটিশদের শেখানো শিক্ষাব্যবস্থায় ইতোমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে দুই শ্রেণীর মানুষের প্রভাব বাংলা প্রদেশের তুলনায় অনেকগুণ বেড়ে যায় । একশ্রেণী পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন সেক্টরে নিয়োজিত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে অন্যদিকে ব্রিটিশদের শেখানো বিকৃত ইসলামের আলেমরা ফতোয়াতে বাংলা প্রদেশকে হিন্দুর দেশ ও বাংলাভাষাকে হিন্দুর ভাষা হিসেবে আখ্যায়িত করে । পরবর্তীতে আলেমদের ফতোয়াতে ও ব্রিটিশদের শেখানো স্বৈরাচার শাসনব্যবস্থায় জোরপূর্বক এদেশের রাষ্ট্রভাষাকে বাংলার পরিবর্তে উর্দু করার জোর প্রচেষ্টা চালানো হয় । জন্ম নেয় বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন । উল্লেখ্য, ব্রিটিশদের শেখানো বিকৃত ইসলামে শিক্ষিত পশ্চিম পাকিস্তানের আলেম শ্রেণীটির সাথে বাংলা প্রদেশের আলেমের যথেষ্ট সহমত ছিলো যা একাত্তরে তাদের মাধ্যমে ইসলামকে পুজিঁ করে ‘আলবদর’, ‘আলশামস’ ‘শা্ন্তিকমিটি’ ইত্যাদি গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার মাধ্যমে প্রকাশ পায় । এদেশে ধর্ম নিয়ে যারা আজও অপরাজনীতি করে যাচ্ছে তাদের এক শ্রেণী এবং অতি উৎসাহী নাস্তিকদের এক শ্রেণী একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে ‘ধর্মীয় যুদ্ধ’ বলে অপপ্রচার করে যাচ্ছে । তাদের এই অপপ্রচারই প্রমান করছে তারা স্বার্থপক্ষ হাসিল করার জন্যই এসব করছে । কারণ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যদি ইসলামের বিরুদ্ধে হতো, তাহলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৭ ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে ‘ইনশাআল্লাহ’ শব্দটা ভুলক্রমেই উচ্চারণ করতেন না । মুক্তিযুদ্ধ করতে যারা মরে গিয়েছিলো তাঁদের নামের আগে ‘শহীদ’ শব্দটা কখনই যোগ হতোনা, রূহের মাগফেরাতও কামনা করা হতোনা । আর যে মুক্তিযোদ্ধারা আজও বেঁচে আছেন তাঁরা সবাই ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগ করতেন । লাহোরে বঙ্গবন্ধু ছয়দফার যে প্রস্তাবনামা উত্থাপন করে সেখানে বাংলা প্রদেশে স্বাধীন প্রাদৈশিক নির্বাচন, অর্থ্যনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক, সামাজিক বিভিন্ন বৈষম্যের বিপরীতে ধর্মের কথা লিখা থাকতো । ঐ দুই শ্রেণীর কাছে প্রশ্ন হলো- এসবের কোনটা এ পর্যন্ত বাস্তবে পরিণত হয়েছে বা কোনটা সত্য ছিলো? তবু এই দুটো শ্রেণী স্বাধীনতার পরও বারবার চেষ্টা করে যাচ্ছে জাতিকে চরম বহুখন্ডে বিভক্ত করার জন্য । তাদের এই চেষ্টার ফলই হলো শাহবাগ ও শাপলা চত্ত্বর আন্দোলনের ইতিবৃত্ত ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ব্রিটিশরা যখন আর ভারতবর্ষকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলোনা, যখন দেখলো ভারতবর্ষকে আর শোষণ করার মতো বাকি কিছুই অবশিষ্ট ছিলোনা, তখন তারা ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দিলো, তার সাথে আরো একটা বর দিলো, সেটা হলো গনতন্ত্র । যদিও নিজেরা ভারতবর্ষকে দীর্ঘদিন ধরে শাসনের সময় একটি মুহুর্তের্ জন্যও গণতন্ত্রকে স্মরণ করেনি, চাবুক আর বুটের লাথিই ছিলো তাদের শাসন নীতি । ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে গিয়েছে আর রেখে গেছে তাদের রোপিত অনৈক্যের শিক্ষানীতি, গণতন্ত্র, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচারনীতি, ধর্মীয়-রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক মূলক রাজনীতি, যার প্রতিনিয়ত শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের মতো দুর্বল রাষ্ট্রগুলো । একাত্তরের বিজয়ের মাধ্যমে আমরা শুধু এতোটুকুন অর্জন করেছি যে, বিশ্বের মানচিত্রে একটা স্থায়ী জায়গা, লাল-সবুজের পতাকা, পশ্চিম পাকিস্তানের সকল বৈষম্য-শোষণ থেকে মুক্তি আর একটা দীর্ঘশ্বাস । বিনিময় আমাদের অনেক রক্ত দিতে হয়েছে, দিতে হয়েছে লক্ষকোটি প্রাণ । আজকের বাংলাদেশ একাত্তরেও দেখিয়েছিলো জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ । যার কারণেই বিজয় লাভ করা সম্ভব হয়েছিলো । স্বাধীনতা লাভ করা সত্ত্বেও আজ ৪৩ বছর পরেও মুখ থুবড়ে পড়ে আছে এ জাতি । কারণ ব্রিটিশদের প্রতিষ্ঠিত নীতি থেকে আমরা আজ এতোটুকুনও বিচলিত হতে পারিনি । তাদের দেয়া শিক্ষানীতি থেকে প্রতিনিয়ত বের হচ্ছে পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণীয় প্রসিকিউটর রায়বাহাদুর তারকানাথ সাধু । আদর্শ বলতে আমরা বুঝি পাশ্চাত্য, উন্নত বলতেই আমরা বুঝি পাশ্চাত্য, হোক সেটা শিক্ষা-সংস্কৃতি-সভ্যতার যেকোন একদিক । ভারতবর্ষের মানুষ আজ প্রাচ্যকে দেখে অনগ্রসর, গেঁয়ো এক সভ্যতা হিসেবে । তাই নিজেকে উন্নত করতে এদেশের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মত্তোর বিলেতে পাড়ি জমায়, সেখানে স্থায়ীভাবে বাস করে, আর নিজের পিতৃপুরুষদের ভারতবর্ষকে গালি দেয় । অথচ এ ভারতবর্ষই একদিন ছিলো বাণিজ্য করার যোগ্যতম জায়গা । এখানেই জন্মেছিলো রাম, কৃষ্ণ, যুধিষ্ঠির, সিদ্ধার্থের মতো মহামানব । এখানেই জন্মেছিলো ভাস্কারাচার্য, রামানুজানের মতো বিখ্যাত গণিতবিদ । এখানেই জন্মেছিলো চীন বিখ্যাত গুরু, ভেষজ চিকিৎসক, চীনের মার্শাল আর্টস শাওলিন মন্দিরের প্রতিষ্ঠিাতা বোধিধম্মণ । এই ভারতবর্ষ ছিলো ভেষজ, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাসহ সমস্তরকম জ্ঞানভান্ডারের আধার । আর আজকের দিন আমাদের সমস্ত দৃষ্টিভঙ্গি পাশ্চাত্যকে ঘিরে । দলাদলি-সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় একদিকে নিজেই নিজেরা মরছি, আর অন্যদিকে ভুলে যাচ্ছি আমাদের অতীত ইতিহাস । পাশ্চাত্য অন্ধমুখীতা থেকে আজও আমরা বের হতে পারছিনা, অথচ পাশ্চাত্যনীতিই ভারতবর্ষকে পরিণত করেছে অনগ্রসর, পশ্চাতগামীতায় । এখানে এখন প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, খুন-হত্যা-গুম, ধর্ষণ-রাহাজানি-ছিনতাই, সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ-ধর্মীয় অপরাজনীতি ইত্যাদি । একটা জিনিস কখনই ভুলে গেলে চলবেনা, জাতির উন্নতির পরিমাপ যান্ত্রিক প্রগতি নয়, শান্তি ।
আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই শান্তি চাই, আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে অসাম্প্রদায়িক, অখন্ডনীয়, স্বকীয়নীতির ভারতবর্ষে । যেখানে থাকবেনা কোনো কাঁটাতার, র্যাডক্লিফ লাইন, সীমান্তচুক্তি, নদীবাধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা । আমাদের ফিরে যেতে হবে আমাদের হারানো নীতিবোধের দিকে যেখানে শাস্ত্রের শাসনে ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো রামরাজত্ব । ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সম্প্রীতির মেলবন্ধনে আমরা যদি জাত-পাত–অনৈক্যের ঊর্ধ্বে প্রাণে প্রাণ মিলাতে পারি, কাধেঁ কাঁধ রেখে মানবতার কাজ করতে পারি, ভারতবর্ষে আবারো নেমে আসবে স্বর্গীয় সুধা, বারিবর্ষণে মুখরিত হবে গুজরাট, তেলেগু, মুম্বাই, কাশ্মীর, বেলুচিস্তান, করাচী, ঢাকা, কোলকাতাসহ সমগ্র ভারতবর্ষ । ব্রিটিশদের চাপিয়ে দেয়া সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রথম শর্তই হলো সমগ্র ভারতবর্ষকে এক স্রষ্টারনীতিতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলো একাত্তরে । শুধু এতোটুকুন সদিচ্ছার উপর নির্ভর করছে সুখী-সমৃদ্ধ-সম্প্রীতিতে পরিপূর্ণ আগামীর ভারতবর্ষ, যে স্বপ্নের জাল বুনে গেছেন অনেক জ্ঞানীগুণীজনেরা । তার মধ্যে শাহ আব্দুল করীমের গানে সরাসরি ফুটে উঠেছে-
“আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা
আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম !
গ্রামের নওজোয়ান, হিন্দু-মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম !
হিন্দু বাড়িতে যাত্রা গান হইতো,
নিমন্ত্রন দিতো, আমরা যাইতাম !
জারিগান বাউলগান আনন্দের তুফান,
গাইয়া সারিগান নৌকা দৌড়াইতাম !
বর্ষা যখন হইতো, গাজির গান আইতো,
রঙ্গে ঢঙ্গে গাইতো আনন্দ পাইতাম !
কে হবে মেম্বার কে বা সরকার,
আমরা কী তার খবরও লইতাম?
আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম !
করি যে ভাবনা, সেইদিন আর পাবোনা?
ছিলো বাসনা সুখী হইতাম !
দিন হতে দিন, আসে যে কঠিন
করিম দীনহীন কোনপথে যাইতাম
আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম !”
এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে প্রত্যেককে । সিদ্ধান্ত নিতে হবে এটার উপর যে, আপনি নিজেকে ব্রিটিশদের পা চাটা গোলাম জগৎশেঠ-মীরজাফর-প্রসিকিউটর রায়বাহাদুর তারকানাথ হিসেবে দেখাতে চান? নাকি ব্রিটিশবিরোধী নজরূল-রবীন্দ্রনাথ-ক্ষুদিরাম হিসেবে? অফিস-আদালত পাড়ায় লুঙ্গি-ধুতি-পাঞ্জাবী পরে বিলেতী বাবু সাজতে আপনার বিবেকে বাঁধেনা, বিবেকে বাঁধে তখন, যখন ব্রিটিশদের চাপিয়ে দেয়া জীবনব্যবস্থার পরিবর্তে ভারতবর্ষের চিরায়ত জীবনব্যবস্থার কথা বলা হয় । বিবেকে বাঁধে তখন, যখন অনৈক্যের পরিবর্তে ঐক্য, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সম্প্রীতির কথা বলা হয় । বিবেকে বাঁধে তখন, যখন ব্রিটিশদের শিক্ষায় শিক্ষিত ধর্মব্যবসায়ী আলেম, পাশ্চাত্যের অন্ধঅনুকরণ আর গ্রহণযোগ্যতায় বিশ্বাসী বুদ্ধিজীবী আর মিডিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বলা হয় । জানিনা, এতোকিছু বলার পরও কি কিছু মিলবে ! সবার দৃষ্টিভঙ্গি কোনদিকে যাবে, সেটা যদি তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে পরিণত হয় তাহলে আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের কথায় কী আসে যায় ! শাহ আব্দুল করীমের মতো শান্তিপ্রিয় লোকদের আফসোসে ভরা একটাই গান বারবার গাইতে হবে,
“আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম…!”
0 comments:
Post a Comment