ধর্মব্যবসায়ীদের কূপমণ্ডূকতায় ব্যর্থ হল লেনিনের পরিকল্পনা (বামদের জন্য শিক্ষনীয়)
সারা দুনিয়ায় কিছুদিন আগে বাম আদর্শের জয়জয়কার ছিল, এখনও বাম আন্দোলন
টিকে আছে তাত্ত্বিকভাবে, বহু মানুষের মুখে বামপন্থীদের নাম সম্মান ও
শ্রদ্ধার সঙ্গে এখনো উচ্চারিত হয়। পুরো রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপ, দক্ষিণ
আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা, ভারত উপমহাদেশের বুদ্ধিজীবী মহল, শিল্পী,
সাহিত্যিক, রাজনীতিক, শিক্ষক-ছাত্রদের মধ্যে একটি বৃহৎ অংশ বাম ঘরানার।
আমরা বাম আদর্শের উৎপত্তির কারণ সম্পর্কে যতটুকু জানতে পারি তা হচ্ছে,
ইংল্যান্ডে যখন প্রথম রাষ্ট্রীয়জীবনে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা আরম্ভ হলো তখন
থেকেই মানুষ জাতীয় চরিত্রে চরম বৈষয়িক ও বস্তুবাদী হয়ে পড়তে আরম্ভ করল। তখন
অর্থনীতি ছিল সুদভিত্তিক পুঁজিবাদ এবং শাসনতন্ত্র ছিল সামন্তবাদ। সুদী
অর্থনীতির ফলে সমাজের কেউ হয়ে গেল অকল্পনীয় অর্থ-বিত্তের মালিক আর কেউ হয়ে
গেল দারিদ্র্যের নির্মম শিকার। শিল্পবিপ্লবের ছোঁয়ায় খনিজ সম্পদসহ বিভিন্ন
প্রাকৃতিক কাঁচামাল থেকে ব্যবহার্য সামগ্রী উৎপাদনকারী যে বিপুল সংখ্যক
কারখানা সৃষ্টি হলো, প্রায় কোটি কোটি মানুষকে একরকম বাধ্য করা হলো সামান্য
মজুরিতে সেই কারখানাগুলোতে শ্রমিক হিসাবে কাজ করার জন্য। সামন্তবাদী
রাষ্ট্রগুলোতে এই শ্রমিকবর্গসহ নিু শ্রেণির মানুষগুলোর শিক্ষা, চিকিৎসা,
বাসস্থান ইত্যাদির কোনো ব্যবস্থা রইল না, তারা মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য
হলো। আজকের সংশোধিত পুঁজিবাদী গণতন্ত্রে ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রমিক সংগঠনগুলোর
দাবি দাওয়া ও আন্দোলনের কারণে, শ্রমজীবী মানুষের বিক্ষোভের ভয়ে কিছু কিছু
অধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু আজ থেকে ১০০ বছর আগেও এই গণতন্ত্রের সমাজব্যবস্থায়
শ্রেণিহীন মানুষের দুর্গতির কথা পড়লে চোখের পানি ধরে রাখতে কষ্ট হয়। এই
অবস্থার কারণে ইউরোপের জ্ঞানী-গুণী, বুদ্ধিজীবীরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন যে,
কী করে এই মানুষগুলোকে মুক্তি দেয়া যায়? সেই জ্ঞানী-গুণী, মুক্তচিন্তার
মানুষগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলেন কার্ল মার্কস, লেনিন এরা। তারা চেষ্টা করলেন
মানুষকে অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে মুক্তি দেবার জন্য। যতটুকু বোঝা যায় তাদের
অভিপ্রায় ভালোই ছিল। তখন তারা চিন্তা করে দেখলেন যে, ধর্মের মধ্যে সমাধান
খুঁজে লাভ নেই, সেগুলো মানুষকে বুঁদ করে ফেলে, সেগুলো মানুষের ব্যবহারিক
জীবনের যাবতীয় সমস্যার সমাধান দিতে অক্ষম।
ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্রের পাশবিক পীড়নের পর বিংশ শতকের গোড়ার দিকে মানবজাতির সামনে আশার বাতি নিয়ে হাজির হয়েছিল সমাজতন্ত্র নামক মতবাদ। পতঙ্গ যেমন অন্ধ মোহে আগুনের শিখায় ঝাঁপিয়ে পড়ে তেমনি সারা পৃথিবীর তরুণ যুবক সমাজতন্ত্রের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। মানুষের ভিতরে বিপ্লবের যে চিরন্তন আকাক্সক্ষা সুপ্ত থাকে সেটা জাগিয়ে তুলেছিল সমাজতান্ত্রিক পুরোধারা। কিন্তু আগুনে ঝাঁপ দিয়ে পতঙ্গের যা পরিণতি হয়, অর্থাৎ মৃত্যু; সমাজতন্ত্রের বেলাতেও সেটাই ঘোটেছে। চাকচিক্যময় মাকাল ফল সদৃশ এই মার্কসীয় মতবাদের অভ্যন্তরে যে বিষময় কদর্যতা লুকিয়ে আছে তার প্রকাশ ঘটতে ৭৫ বছরের অধিক সময় পার হয়ে গিয়েছিল। পৃথিবীর যে কয়টি স্থানেই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সেখানেই সৃষ্টি হয়েছিল চূড়ান্ত ভারসাম্যহীনতা, শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি, পদদলিত হয়েছিল মানবতা। মানুষের আত্মা ত্রাহিস্বরে চিৎকার করে উঠেছিল কেবল মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছা নিয়ে। অথচ এই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে মার্কস লেনিন প্রমুখ তাত্ত্বিকরা আখ্যা দিয়েছিলেন ‘স্বর্গরাজ্য’। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার পর থেকে তাদের প্রচারযন্ত্রের মাধ্যমে অর্থাৎ রেডিও, টেলিভিশনে-এ কথা লক্ষ কোটি বার বলা হয়েছে যে সাম্যবাদী সমাজে, দেশে থাকা স্বর্গের সুখে থাকার সমান। এখানে লক্ষণীয় যে, তারা তাদের সমাজটাকে সর্বদাই স্বর্গ (চধৎধফরংব) বলে বাকি পৃথিবীকে সাম্যবাদ গ্রহণ করে স্বর্গে প্রবেশের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে উদ্ভূত কঠিন বাস্তবতাই প্রমাণ করে দিয়েছে যে সমাজতন্ত্র যে স্বপ্ন দেখিয়েছে সেটা বাস্তবতার ঠিক উল্টো।
কমিউনিস্টদের এই নিদারুণ ব্যর্থতার কারণ আগেই বলেছি যে মানুষ কেবল দেহ নয়, তার আত্মাও আছে। এ বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলেন কার্ল মার্কসের তত্ত্বের বাস্তব রূপকার ভ.ই.লেনিন কিন্তু এর কোনো সমাধান করে যেতে পারেন নি দু’টি কারণে। প্রথমত ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্র, এবং দ্বিতীয়ত বিকৃত ইসলামের ধারক-বাহক কূপমণ্ডূক মোল্লাদের ইসলাম-পরিপন্থী ফতোয়াবাজি।
সমাজতন্ত্রীরা নিজেদেরকে প্রগতিশীল, যুক্তিবাদী, মুক্তচিন্তার ধ্বজাধারী মনে করেন এবং পক্ষান্তরে ইসলামসহ সকল ধর্মমতকে একচেটিয়াভাবে অবজ্ঞা ও ঘৃণা করেন, সকল ধর্মকে স্থবির, কল্পকাহিনী, জড়তা, কূপমণ্ডূকতা বলে গালিগালাজ করেন, বিশেষ করে মুসলিমদেরকে পশ্চাৎপদ, গোঁড়া, মধ্যযুগীয়, অন্ধ বলেন। এটা বলেন কেন? এটা বলার কারণ, আপনারা মসজিদে, মাদ্রাসা, খানকার চার দেয়ালের ভেতরে দাড়িওয়ালা-টুপিওয়ালা, লম্বা পাগড়ীওয়ালা লেবাসধারী মওলানা ও পীর সাহেবদেরকে দেখে মনে করেন এটাই বুঝি ইসলাম। কিন্তু না, এটা প্রকৃত ইসলাম নয়। প্রকৃত ইসলামের অনুসারীরা কখনও স্থবির হতে পারেন না, প্রকৃত ইসলামের চেয়ে বিস্ফোরণমুখী, গতিশীল, বৈপ্লবিক আর কিছু হতে পারে না। তারা কখনও কূপমণ্ডূক নয়, তাদের সংস্কৃতি রুদ্ধ নয়। দুনিয়াজোড়া তাদের দৃষ্টি। তারা নির্দিষ্ট কোনো পোশাকী গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকতে পারেন না, কারণ যে জীবনব্যবস্থা এসেছে সারা পৃথিবীর সব ভৌগোলিক পরিবেশের মানুষের জন্য, সেই জীবনব্যবস্থায় কোনো নির্দিষ্ট পোশাক থাকতে পারে না; ঠিক যে কারণে গণতন্ত্রে বা সমাজতন্ত্রের কোনো নির্দিষ্ট পোশাক নেই।
ঔপনিবেশিক যুগে ব্রিটিশরা ষড়যন্ত্র করে তাদের সকল উপনিবেশগুলোতে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে একেবারে চূড়ান্ত একটা বিকৃত ইসলাম শিক্ষা দিয়ে মুসলিম জাতিকে একেবারে বিপরীত দিকে পরিচালিত করছে। এই ইসলাম যে কতটা বিকৃত তার একটি প্রমাণ লেনিনের জীবন থেকে দেওয়া যায়। ঘটনাটি আমরা উদ্ধৃত করছি মাওলানা শামস নাবীদ উসমানী রচিত Now of Never গ্রন্থ থেকে যা অনুবাদ করেছেন স.স.আলম শাহ। অনুবাদ পুস্তক ‘বেদ-কুর’আন ও স্বজাতির বিভেদ’। আরও দেখুন উর্দু পত্রিকা ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ এর ২৮তম সংখ্যা, ১৯৮২, সূত্র: জগদগুরু মুহাম্মদ (সা.), রেনেসাঁ পাবলিকেশন্স। পৃষ্ঠা-২০৯-২১০।
ঘটনাটি হলো: রাশিয়ার কমিউনিস্ট বিপ্লবের মহানায়ক কমরেড লেনিন বিশ্বধর্মের পর্যালোচনা করার পর ইসলামে গভীরভাবে প্রভাবিত হন। তিনি রুশীয় জনগণের ইসলাম গ্রহণের আশা পোষণ করতেন। কথিত আছে যে, জনৈক বাকরা খাঁন নামক বুযুর্গের সংস্পর্শে আসার পর তিনি ইসলামের প্রতি অনুরক্ত হন। তার দ্বারা লেনিন যথেষ্ট প্রভাবিত হন। যাই হোক, লেনিন সচেষ্ট হয়েছিলেন, কিন্তু মিশরীয় উলামাদের অজ্ঞতা ও অদূরদর্শিতা এবং ব্রিটিশ প্রশাসনের ষড়যন্ত্রের ফলে এই সুযোগ হাতছাড়া হয়।
রাশিয়ার জার-তন্ত্রের পতনের পর লেনিন হন সর্বময়কর্তা। তিনি কমিউনিস্ট প্রশাসন স্থাপন করেন। একদিন তিনি নিকটতম বন্ধুবর্গের বৈঠক ডাকেন। তাতে তিনি বলেন, ‘আমরা সরকার গঠনে সফল হয়েছি কিন্তু একে সুদৃঢ়, সুবিন্যাস্ত, শাশ্বত ও সার্বজনীন করে তোলার জন্য আমাদেরকে এমন এক জীবনব্যবস্থা দিতে হবে যা হবে মানব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মানুষের শুধুমাত্র অন্নবস্ত্রই যথেষ্ট নয়। আত্মার খোরাকও প্রয়োজন। ক্ষুধার্ত মানুষকে রুটি দিয়ে শান্ত রাখা যায় একটা পর্যায় পর্যন্ত। এ পর্যায় অতিক্রান্ত হলে মানবাত্মা তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠে। এ তৃষ্ণা নিবারণের কোনো উপকরণ-ই আমাদের কাছে নেই। আছে ধর্মাচারের মাধ্যে। আমি পৃথিবীর সব ধর্ম-ই গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছি, সবখানে পেয়েছি আফিমের আবেশ। শুধুমাত্র একটি ধর্মকেই পেয়েছি প্রাণবন্ত জীবনব্যবস্থা হিসেবে। এক অনিরুদ্ধ গতিময়তা এর মধ্যে বিদ্যমান। এটাই আমাদের প্রগতিশীল জীবন ধারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সহায়ক বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। এখন সে ধর্মের নাম আমি শুধু বলব। এ ব্যাপারে মত প্রতিষ্ঠায় আপনারা তাড়াহুড়ো করবেন না। কেননা প্রশ্নটি কমিউনিজমের জীবন মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত (Don’t hasten to form your own conclusions because this question pertains to the life and death of Communism.) আপনারা সময় নিয়ে ভাবনা চিন্তা কোরুন। হতে পারে আমার ধারণা ভুল, কিন্তু আমাদের আত্মপ্রশান্তির জন্য ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। আমি মনে করি যে, ইসলামই একমাত্র ধর্ম যার অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সমাজতন্ত্রের নিকটতম (Islam is the only religion closer to the economic programmes of Communism.)” এ কথা শুনে সমবেত লোকদের মধ্যে হইচই শুরু হয়ে যায়। তখন লেনিন তাদেরকে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে নির্দেশ দিয়ে বলেন- আজ থেকে পুরো এক বছর পরে পুনরায় আমরা একত্রিত হব। আর তখনই আমরা ঠিক করব কমিউনিস্টদের ধর্মাশ্রয়ী হওয়া উচিত হবে কি না, যদি গ্রহণ করতেই হয় তাহলে সে ধর্ম কোনটি?”
ব্রিটিশ সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তর এ সংবাদ অবহিত হয়ে এটাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের অশনি সংকেত মনে করল। তারা ভাবলো, যদি উদীয়মান শক্তি কমিউনিস্ট রাশিয়া এবং বিপন্ন বিপর্যস্ত আধমরা লড়াকু মুসলিম জনগোষ্ঠী সংঘবদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে ওপনিবেশিক ব্রিটিশদের বিদায় ঘণ্টা বেজে উঠবে। সুতরাং ব্রিটিশ কূটনৈতিকরা তৎপর হয়ে উঠল বিশ্বব্যাপী। মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া হল এমন এক সংবেদনশীল প্রশ্ন যে কমিউনিজম হলো আল্লাহবিরোধী মতবাদ। ইসলামের জন্য আল্লাহদ্রোহী এই মার্কসীয় মতবাদ কি গ্রহণীয় হতে পারে? ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে মুসলিম বিশ্বের আলেম ওলামার নিকট থেকে ফতোয়া নেয়া হল। একইভাবে এ প্রশ্নে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞ আলেমদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হল। আলেমগণ এ সংক্রান্ত প্রশ্নের পটভূমি ও এর অর্ন্তনিহিত উদ্দেশ্য অবগত ছিলেন না। ফলে আল-আযহারের ওলামাগণ এরূপ নেতিবাচক বিধান প্রকাশ করলেন যা ব্রিটিশ প্রশাসন একান্তভাবে চাইছিল। অতঃপর যা হবার তাই হলো। ব্রিটিশ সরকার এ ফতোয়া ছাপিয়ে সারা বিশ্বে বিলি করল। এখন পর্যন্ত রাশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত অনেক এলাকায় মুসলিমদের অনেকের কাছে এ ফতোয়ার কপি রয়েছে। এ সংবাদ লেনিনও অবগত হলেন। এতে বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন- ‘আমার ধারণা ছিল মুসলিমরা কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। কিন্তু বাস্তবে তারা প্রমাণ করল, অন্য আর সব ধর্মাবলম্বীদের মতো মুসলিমরাও গোঁড়া, তত্ত্বসর্বস্ব ও সংকীর্ণ।’ ফলশ্রুতিতে পরিকল্পনা অপূর্ণ থেকে গেল আর লেনিন বিরোধীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
সেদিন লেলিনের এই প্রস্তাব আলেমরা নিতে পারেন নি। কারণ, তখন মদীনা, কায়রো, লাহোর, দিল্লী, কলকাতা ইত্যাদি জায়গায় যে ব্রিটিশদের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় ব্রিটিশ পণ্ডিতদের তৈরি করা সিলেবাস মোতাবেক যে ইসলাম শিক্ষা দেওয়া হোচ্ছিল (এবং এখনও হচ্ছে) সেটি আদৌ আল্লাহ-রসুলের ইসলাম নয়। সেই ফতোয়া দানকারী ধর্মব্যবসায়ীরা ছিল কূপমণ্ডূক মোল্লা যারা প্রকৃত ইসলামের সাথে সম্পর্কহীন। স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব প্রত্যাখ্যান করে তারা ব্রিটিশ বেনিয়াদের তৈরি মতবাদ ও সার্বভৌমত্ব তারা মেনে নিয়েছে। আজও পৃথিবীময় ধর্মব্যবসায়ীদের পণ্যরূপী সেই অন্তঃসারশূন্য, স্থবির ইসলামকেই আপনারা দেখছেন এবং অনর্থক আল্লাহ-রসুলের প্রতি বিদ্বেষ লালন ও বিস্তার করে যাচ্ছেন।
সেদিন মুক্তমনা মানুষ লেনিনের পুরো রাশিয়ার জনগোষ্ঠীর জাতীয় জীবনে ইসলামকে সহায়ক ব্যবস্থা হিসাবে গ্রহণকে যে ধর্মব্যবসায়ীরা নির্দ্বিধায় প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তাদের মনোভাব ছিল অনেকটা এমন- ঐ ব্যাটা তো নাস্তিক, কাফের। ওকে ইসলাম ধর্মের বিধান ব্যবহার করতে দিলে তো ইসলামের জাত যাবে। আজও একই ধারণা ধর্মজীবীরা পোষণ করেন। তাদের জানা দরকার আল্লাহর রসুলের সময় রসুল যখন প্রকৃত ইসলামের দিকে মানুষকে আহ্বান করেছিলেন তখন তাঁর আহ্বানে ইহুদি, খ্রিষ্টান, নাস্তিক, মূর্তিপূজক, অগ্নিপূজক সব জাতির মানুষ ইসলামের ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। এমন কি রসুলাল্লাহ খ্রিষ্টান শাসক নাজ্জাশির মৃত্যুর পর সাহাবিদেরকে বলেছিলেন যে, তোমাদের একজন ভাই মৃত্যুবরণ করেছেন। রসুলাল্লাহ নিজে তার জানাজার সালাহ কায়েম করিয়েছিলেন। কারণ নাজ্জাশি রসুলাল্লাহর আসহাবদেরকে অকপটে সহযোগিতা করেছিলেন। আমাদের বিশ্বাস লেলিনের উদ্যোগ গৃহিত হলে রাশিয়াতে কমিউনিজমের যাঁতাকলে পড়ে সাধারণ মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত হওয়ার যে দুর্বিসহ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল, তা না হয়ে রাশিয়ার ইতিহাস হতো ভিন্ন ও অনন্য।
১৯৯০-তে সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতা সুস্পষ্ট হয়ে যাওয়ায় মার্কসবাদীদের তীর্থভূমি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায়, তারপরই সারা দুনিয়ায় সমাজতন্ত্র নিক্ষিপ্ত হয় আস্তাকুঁড়ে। সে সময়ের গোঁড়া সমাজতান্ত্রিকরা আজও দুর্বল কণ্ঠে সমাজতন্ত্রের জয়গান করেন কিন্তু বাস্তবে তারা সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা মার্কস লেলিনের আদর্শকে বিসর্জন দিয়েছেন এবং বর্তমানে তারা চরম পূঁজিবাদী গণতন্ত্রের অনুসারী। আপনারা পুঁজিপতিদের অধীনে মন্ত্রিত্ব করছেন, রাজনীতি করছেন, শ্রেণিহীন মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা বাদ দিয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন আর সকল ধর্মের পুরোহিতরা যেমন ধর্মকে বিক্রী করে জীবিকা নির্বাহ করেন আপনারাও মার্কস, লেনিন, এঙ্গেলসকে বিক্রী করছেন। আপনারা খামোখা মানুষদেরকে সাম্যবাদের কথা বলে প্রতারণা করে যাচ্ছেন। আপনারা জানেন যে, আপনাদের সিস্টেম ব্যর্থ ও অচল। এখন গণতন্ত্রের দিন এসেছে, তাই সেদিকেই এখন ছাতা ধরে আছেন। এই কথিত পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের অধীনে থাকায় আপনাদের অনেকেরই ব্যক্তিগত জীবন ঋষ্টপুষ্ট হচ্ছে।
আপনারা যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেন আপনাদের প্রতি আমাদের শেষ কথা হলো, যদি আপনারা সত্যিই মানুষের কল্যাণ চান, তবে আপনাদের উচিত প্রকৃত ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করা যেটা প্রচণ্ড, দুর্দান্ত গতিশীল এক জীবনব্যবস্থা। সেটা মোল্লাদের কাছে নেই, সেটা আল্লাহ দয়া করে হেযবুত তওহীদকে দান করেছেন। সেটা প্রতিষ্ঠিত হলে পৃথিবীতে থাকবে না কোনো ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ, থাকবে না ধর্ম-বর্ণের কোনো ভেদাভেদ, শ্রেণিবৈষম্য, পুরো মানবজাতি হবে এক জাতি। মানব সমাজে এমন অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হবে যে, প্রত্যেকের নিজের মেধা ও পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থের উপর যেমন পূর্ণ অধিকার থাকবে, অপরপক্ষে সমাজের প্রতিটি মানুষ স্বচ্ছল হয়ে যাবে, মানুষ তো দূরের কথা একটি কুকুরও বুভুক্ষ থাকবে না। ধনীর সম্পদে দরিদ্রের ন্যায্য অংশীদারত্ব থাকবে। শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগে তার হাতে মজুরি অর্পিত হবে। মালিক ও শ্রমিক এক টেবিলে বসে খাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হবে। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার জন্য লাইসেন্স লাগবে না, মিথ্যা না বলে যত খুশি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা করা যাবে। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের আঞ্চলিক সংস্কৃতি অপরিবর্তিত থাকবে, সঙ্গীত, নাট্য, চিত্রকলায় কোনোরূপ বাধা আরোপ করা হবে না, কেবলমাত্র যা কিছু মানুষের ক্ষতির কারণ হয় সেগুলি বর্জনীয় বলে বিবেচিত হবে। আমরা বলি না যে, আপনারা আল্লাহ বিশ্বাসী হয়ে যান, মো’মেন হয়ে যান, পরকালে বিশ্বাসী হয়ে যান। আল্লাহর প্রতি কে ঈমান আনবে কে আনবে না সেটা তারা আল্লাহর সঙ্গে বুঝবে। সুতরাং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করানো আমাদের কাজ নয়, আমাদের কাজ আল্লাহর শেষ রসুলের আনীত আকাশের মতো উদার, সমুদ্রের মতো বিশাল, দুর্দান্ত গতিশীল ইসলামকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করে মানবজাতিকে শান্তিময়, নিরাপদ, ন্যায় ও সুবিচারে পূর্ণ একটি জীবন উপহার দেওয়া। দল, মত, পথ, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, আস্তিক, নাস্তিক নির্বিশেষে সকল মনুষ্য সন্তানের প্রতি আমাদের একটিই প্রশ্ন, আপনি মানবজাতির সার্বিক জীবনে সুখ, শান্তি, উন্নতি, প্রগতি ও ন্যায় চান কি না। যদি চান, তাহলে অন্য কারও কথায় প্রভাবিত না হয়ে জানুন আমরা কী বলি।
(আংশিক সম্পাদিত)
লেখক: রিয়াদুল হাসান,
দৈনিক বজ্রশক্তির সাহিত্য্য বিষয়ক সম্পাদক ও হেযবুত তওহীদের সদস্য।
ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্রের পাশবিক পীড়নের পর বিংশ শতকের গোড়ার দিকে মানবজাতির সামনে আশার বাতি নিয়ে হাজির হয়েছিল সমাজতন্ত্র নামক মতবাদ। পতঙ্গ যেমন অন্ধ মোহে আগুনের শিখায় ঝাঁপিয়ে পড়ে তেমনি সারা পৃথিবীর তরুণ যুবক সমাজতন্ত্রের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। মানুষের ভিতরে বিপ্লবের যে চিরন্তন আকাক্সক্ষা সুপ্ত থাকে সেটা জাগিয়ে তুলেছিল সমাজতান্ত্রিক পুরোধারা। কিন্তু আগুনে ঝাঁপ দিয়ে পতঙ্গের যা পরিণতি হয়, অর্থাৎ মৃত্যু; সমাজতন্ত্রের বেলাতেও সেটাই ঘোটেছে। চাকচিক্যময় মাকাল ফল সদৃশ এই মার্কসীয় মতবাদের অভ্যন্তরে যে বিষময় কদর্যতা লুকিয়ে আছে তার প্রকাশ ঘটতে ৭৫ বছরের অধিক সময় পার হয়ে গিয়েছিল। পৃথিবীর যে কয়টি স্থানেই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সেখানেই সৃষ্টি হয়েছিল চূড়ান্ত ভারসাম্যহীনতা, শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি, পদদলিত হয়েছিল মানবতা। মানুষের আত্মা ত্রাহিস্বরে চিৎকার করে উঠেছিল কেবল মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছা নিয়ে। অথচ এই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে মার্কস লেনিন প্রমুখ তাত্ত্বিকরা আখ্যা দিয়েছিলেন ‘স্বর্গরাজ্য’। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার পর থেকে তাদের প্রচারযন্ত্রের মাধ্যমে অর্থাৎ রেডিও, টেলিভিশনে-এ কথা লক্ষ কোটি বার বলা হয়েছে যে সাম্যবাদী সমাজে, দেশে থাকা স্বর্গের সুখে থাকার সমান। এখানে লক্ষণীয় যে, তারা তাদের সমাজটাকে সর্বদাই স্বর্গ (চধৎধফরংব) বলে বাকি পৃথিবীকে সাম্যবাদ গ্রহণ করে স্বর্গে প্রবেশের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে উদ্ভূত কঠিন বাস্তবতাই প্রমাণ করে দিয়েছে যে সমাজতন্ত্র যে স্বপ্ন দেখিয়েছে সেটা বাস্তবতার ঠিক উল্টো।
কমিউনিস্টদের এই নিদারুণ ব্যর্থতার কারণ আগেই বলেছি যে মানুষ কেবল দেহ নয়, তার আত্মাও আছে। এ বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলেন কার্ল মার্কসের তত্ত্বের বাস্তব রূপকার ভ.ই.লেনিন কিন্তু এর কোনো সমাধান করে যেতে পারেন নি দু’টি কারণে। প্রথমত ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্র, এবং দ্বিতীয়ত বিকৃত ইসলামের ধারক-বাহক কূপমণ্ডূক মোল্লাদের ইসলাম-পরিপন্থী ফতোয়াবাজি।
সমাজতন্ত্রীরা নিজেদেরকে প্রগতিশীল, যুক্তিবাদী, মুক্তচিন্তার ধ্বজাধারী মনে করেন এবং পক্ষান্তরে ইসলামসহ সকল ধর্মমতকে একচেটিয়াভাবে অবজ্ঞা ও ঘৃণা করেন, সকল ধর্মকে স্থবির, কল্পকাহিনী, জড়তা, কূপমণ্ডূকতা বলে গালিগালাজ করেন, বিশেষ করে মুসলিমদেরকে পশ্চাৎপদ, গোঁড়া, মধ্যযুগীয়, অন্ধ বলেন। এটা বলেন কেন? এটা বলার কারণ, আপনারা মসজিদে, মাদ্রাসা, খানকার চার দেয়ালের ভেতরে দাড়িওয়ালা-টুপিওয়ালা, লম্বা পাগড়ীওয়ালা লেবাসধারী মওলানা ও পীর সাহেবদেরকে দেখে মনে করেন এটাই বুঝি ইসলাম। কিন্তু না, এটা প্রকৃত ইসলাম নয়। প্রকৃত ইসলামের অনুসারীরা কখনও স্থবির হতে পারেন না, প্রকৃত ইসলামের চেয়ে বিস্ফোরণমুখী, গতিশীল, বৈপ্লবিক আর কিছু হতে পারে না। তারা কখনও কূপমণ্ডূক নয়, তাদের সংস্কৃতি রুদ্ধ নয়। দুনিয়াজোড়া তাদের দৃষ্টি। তারা নির্দিষ্ট কোনো পোশাকী গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকতে পারেন না, কারণ যে জীবনব্যবস্থা এসেছে সারা পৃথিবীর সব ভৌগোলিক পরিবেশের মানুষের জন্য, সেই জীবনব্যবস্থায় কোনো নির্দিষ্ট পোশাক থাকতে পারে না; ঠিক যে কারণে গণতন্ত্রে বা সমাজতন্ত্রের কোনো নির্দিষ্ট পোশাক নেই।
ঔপনিবেশিক যুগে ব্রিটিশরা ষড়যন্ত্র করে তাদের সকল উপনিবেশগুলোতে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে একেবারে চূড়ান্ত একটা বিকৃত ইসলাম শিক্ষা দিয়ে মুসলিম জাতিকে একেবারে বিপরীত দিকে পরিচালিত করছে। এই ইসলাম যে কতটা বিকৃত তার একটি প্রমাণ লেনিনের জীবন থেকে দেওয়া যায়। ঘটনাটি আমরা উদ্ধৃত করছি মাওলানা শামস নাবীদ উসমানী রচিত Now of Never গ্রন্থ থেকে যা অনুবাদ করেছেন স.স.আলম শাহ। অনুবাদ পুস্তক ‘বেদ-কুর’আন ও স্বজাতির বিভেদ’। আরও দেখুন উর্দু পত্রিকা ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ এর ২৮তম সংখ্যা, ১৯৮২, সূত্র: জগদগুরু মুহাম্মদ (সা.), রেনেসাঁ পাবলিকেশন্স। পৃষ্ঠা-২০৯-২১০।
ঘটনাটি হলো: রাশিয়ার কমিউনিস্ট বিপ্লবের মহানায়ক কমরেড লেনিন বিশ্বধর্মের পর্যালোচনা করার পর ইসলামে গভীরভাবে প্রভাবিত হন। তিনি রুশীয় জনগণের ইসলাম গ্রহণের আশা পোষণ করতেন। কথিত আছে যে, জনৈক বাকরা খাঁন নামক বুযুর্গের সংস্পর্শে আসার পর তিনি ইসলামের প্রতি অনুরক্ত হন। তার দ্বারা লেনিন যথেষ্ট প্রভাবিত হন। যাই হোক, লেনিন সচেষ্ট হয়েছিলেন, কিন্তু মিশরীয় উলামাদের অজ্ঞতা ও অদূরদর্শিতা এবং ব্রিটিশ প্রশাসনের ষড়যন্ত্রের ফলে এই সুযোগ হাতছাড়া হয়।
রাশিয়ার জার-তন্ত্রের পতনের পর লেনিন হন সর্বময়কর্তা। তিনি কমিউনিস্ট প্রশাসন স্থাপন করেন। একদিন তিনি নিকটতম বন্ধুবর্গের বৈঠক ডাকেন। তাতে তিনি বলেন, ‘আমরা সরকার গঠনে সফল হয়েছি কিন্তু একে সুদৃঢ়, সুবিন্যাস্ত, শাশ্বত ও সার্বজনীন করে তোলার জন্য আমাদেরকে এমন এক জীবনব্যবস্থা দিতে হবে যা হবে মানব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মানুষের শুধুমাত্র অন্নবস্ত্রই যথেষ্ট নয়। আত্মার খোরাকও প্রয়োজন। ক্ষুধার্ত মানুষকে রুটি দিয়ে শান্ত রাখা যায় একটা পর্যায় পর্যন্ত। এ পর্যায় অতিক্রান্ত হলে মানবাত্মা তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠে। এ তৃষ্ণা নিবারণের কোনো উপকরণ-ই আমাদের কাছে নেই। আছে ধর্মাচারের মাধ্যে। আমি পৃথিবীর সব ধর্ম-ই গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছি, সবখানে পেয়েছি আফিমের আবেশ। শুধুমাত্র একটি ধর্মকেই পেয়েছি প্রাণবন্ত জীবনব্যবস্থা হিসেবে। এক অনিরুদ্ধ গতিময়তা এর মধ্যে বিদ্যমান। এটাই আমাদের প্রগতিশীল জীবন ধারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সহায়ক বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। এখন সে ধর্মের নাম আমি শুধু বলব। এ ব্যাপারে মত প্রতিষ্ঠায় আপনারা তাড়াহুড়ো করবেন না। কেননা প্রশ্নটি কমিউনিজমের জীবন মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত (Don’t hasten to form your own conclusions because this question pertains to the life and death of Communism.) আপনারা সময় নিয়ে ভাবনা চিন্তা কোরুন। হতে পারে আমার ধারণা ভুল, কিন্তু আমাদের আত্মপ্রশান্তির জন্য ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। আমি মনে করি যে, ইসলামই একমাত্র ধর্ম যার অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সমাজতন্ত্রের নিকটতম (Islam is the only religion closer to the economic programmes of Communism.)” এ কথা শুনে সমবেত লোকদের মধ্যে হইচই শুরু হয়ে যায়। তখন লেনিন তাদেরকে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে নির্দেশ দিয়ে বলেন- আজ থেকে পুরো এক বছর পরে পুনরায় আমরা একত্রিত হব। আর তখনই আমরা ঠিক করব কমিউনিস্টদের ধর্মাশ্রয়ী হওয়া উচিত হবে কি না, যদি গ্রহণ করতেই হয় তাহলে সে ধর্ম কোনটি?”
![]() |
লেনিন |
ব্রিটিশ সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তর এ সংবাদ অবহিত হয়ে এটাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের অশনি সংকেত মনে করল। তারা ভাবলো, যদি উদীয়মান শক্তি কমিউনিস্ট রাশিয়া এবং বিপন্ন বিপর্যস্ত আধমরা লড়াকু মুসলিম জনগোষ্ঠী সংঘবদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে ওপনিবেশিক ব্রিটিশদের বিদায় ঘণ্টা বেজে উঠবে। সুতরাং ব্রিটিশ কূটনৈতিকরা তৎপর হয়ে উঠল বিশ্বব্যাপী। মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া হল এমন এক সংবেদনশীল প্রশ্ন যে কমিউনিজম হলো আল্লাহবিরোধী মতবাদ। ইসলামের জন্য আল্লাহদ্রোহী এই মার্কসীয় মতবাদ কি গ্রহণীয় হতে পারে? ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে মুসলিম বিশ্বের আলেম ওলামার নিকট থেকে ফতোয়া নেয়া হল। একইভাবে এ প্রশ্নে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞ আলেমদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হল। আলেমগণ এ সংক্রান্ত প্রশ্নের পটভূমি ও এর অর্ন্তনিহিত উদ্দেশ্য অবগত ছিলেন না। ফলে আল-আযহারের ওলামাগণ এরূপ নেতিবাচক বিধান প্রকাশ করলেন যা ব্রিটিশ প্রশাসন একান্তভাবে চাইছিল। অতঃপর যা হবার তাই হলো। ব্রিটিশ সরকার এ ফতোয়া ছাপিয়ে সারা বিশ্বে বিলি করল। এখন পর্যন্ত রাশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত অনেক এলাকায় মুসলিমদের অনেকের কাছে এ ফতোয়ার কপি রয়েছে। এ সংবাদ লেনিনও অবগত হলেন। এতে বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন- ‘আমার ধারণা ছিল মুসলিমরা কৌশল ও বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। কিন্তু বাস্তবে তারা প্রমাণ করল, অন্য আর সব ধর্মাবলম্বীদের মতো মুসলিমরাও গোঁড়া, তত্ত্বসর্বস্ব ও সংকীর্ণ।’ ফলশ্রুতিতে পরিকল্পনা অপূর্ণ থেকে গেল আর লেনিন বিরোধীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
সেদিন লেলিনের এই প্রস্তাব আলেমরা নিতে পারেন নি। কারণ, তখন মদীনা, কায়রো, লাহোর, দিল্লী, কলকাতা ইত্যাদি জায়গায় যে ব্রিটিশদের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় ব্রিটিশ পণ্ডিতদের তৈরি করা সিলেবাস মোতাবেক যে ইসলাম শিক্ষা দেওয়া হোচ্ছিল (এবং এখনও হচ্ছে) সেটি আদৌ আল্লাহ-রসুলের ইসলাম নয়। সেই ফতোয়া দানকারী ধর্মব্যবসায়ীরা ছিল কূপমণ্ডূক মোল্লা যারা প্রকৃত ইসলামের সাথে সম্পর্কহীন। স্রষ্টার সার্বভৌমত্ব প্রত্যাখ্যান করে তারা ব্রিটিশ বেনিয়াদের তৈরি মতবাদ ও সার্বভৌমত্ব তারা মেনে নিয়েছে। আজও পৃথিবীময় ধর্মব্যবসায়ীদের পণ্যরূপী সেই অন্তঃসারশূন্য, স্থবির ইসলামকেই আপনারা দেখছেন এবং অনর্থক আল্লাহ-রসুলের প্রতি বিদ্বেষ লালন ও বিস্তার করে যাচ্ছেন।
সেদিন মুক্তমনা মানুষ লেনিনের পুরো রাশিয়ার জনগোষ্ঠীর জাতীয় জীবনে ইসলামকে সহায়ক ব্যবস্থা হিসাবে গ্রহণকে যে ধর্মব্যবসায়ীরা নির্দ্বিধায় প্রত্যাখ্যান করেছিলেন তাদের মনোভাব ছিল অনেকটা এমন- ঐ ব্যাটা তো নাস্তিক, কাফের। ওকে ইসলাম ধর্মের বিধান ব্যবহার করতে দিলে তো ইসলামের জাত যাবে। আজও একই ধারণা ধর্মজীবীরা পোষণ করেন। তাদের জানা দরকার আল্লাহর রসুলের সময় রসুল যখন প্রকৃত ইসলামের দিকে মানুষকে আহ্বান করেছিলেন তখন তাঁর আহ্বানে ইহুদি, খ্রিষ্টান, নাস্তিক, মূর্তিপূজক, অগ্নিপূজক সব জাতির মানুষ ইসলামের ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। এমন কি রসুলাল্লাহ খ্রিষ্টান শাসক নাজ্জাশির মৃত্যুর পর সাহাবিদেরকে বলেছিলেন যে, তোমাদের একজন ভাই মৃত্যুবরণ করেছেন। রসুলাল্লাহ নিজে তার জানাজার সালাহ কায়েম করিয়েছিলেন। কারণ নাজ্জাশি রসুলাল্লাহর আসহাবদেরকে অকপটে সহযোগিতা করেছিলেন। আমাদের বিশ্বাস লেলিনের উদ্যোগ গৃহিত হলে রাশিয়াতে কমিউনিজমের যাঁতাকলে পড়ে সাধারণ মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত হওয়ার যে দুর্বিসহ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল, তা না হয়ে রাশিয়ার ইতিহাস হতো ভিন্ন ও অনন্য।
১৯৯০-তে সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতা সুস্পষ্ট হয়ে যাওয়ায় মার্কসবাদীদের তীর্থভূমি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায়, তারপরই সারা দুনিয়ায় সমাজতন্ত্র নিক্ষিপ্ত হয় আস্তাকুঁড়ে। সে সময়ের গোঁড়া সমাজতান্ত্রিকরা আজও দুর্বল কণ্ঠে সমাজতন্ত্রের জয়গান করেন কিন্তু বাস্তবে তারা সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা মার্কস লেলিনের আদর্শকে বিসর্জন দিয়েছেন এবং বর্তমানে তারা চরম পূঁজিবাদী গণতন্ত্রের অনুসারী। আপনারা পুঁজিপতিদের অধীনে মন্ত্রিত্ব করছেন, রাজনীতি করছেন, শ্রেণিহীন মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা বাদ দিয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন আর সকল ধর্মের পুরোহিতরা যেমন ধর্মকে বিক্রী করে জীবিকা নির্বাহ করেন আপনারাও মার্কস, লেনিন, এঙ্গেলসকে বিক্রী করছেন। আপনারা খামোখা মানুষদেরকে সাম্যবাদের কথা বলে প্রতারণা করে যাচ্ছেন। আপনারা জানেন যে, আপনাদের সিস্টেম ব্যর্থ ও অচল। এখন গণতন্ত্রের দিন এসেছে, তাই সেদিকেই এখন ছাতা ধরে আছেন। এই কথিত পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের অধীনে থাকায় আপনাদের অনেকেরই ব্যক্তিগত জীবন ঋষ্টপুষ্ট হচ্ছে।
আপনারা যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেন আপনাদের প্রতি আমাদের শেষ কথা হলো, যদি আপনারা সত্যিই মানুষের কল্যাণ চান, তবে আপনাদের উচিত প্রকৃত ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করা যেটা প্রচণ্ড, দুর্দান্ত গতিশীল এক জীবনব্যবস্থা। সেটা মোল্লাদের কাছে নেই, সেটা আল্লাহ দয়া করে হেযবুত তওহীদকে দান করেছেন। সেটা প্রতিষ্ঠিত হলে পৃথিবীতে থাকবে না কোনো ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ, থাকবে না ধর্ম-বর্ণের কোনো ভেদাভেদ, শ্রেণিবৈষম্য, পুরো মানবজাতি হবে এক জাতি। মানব সমাজে এমন অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হবে যে, প্রত্যেকের নিজের মেধা ও পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থের উপর যেমন পূর্ণ অধিকার থাকবে, অপরপক্ষে সমাজের প্রতিটি মানুষ স্বচ্ছল হয়ে যাবে, মানুষ তো দূরের কথা একটি কুকুরও বুভুক্ষ থাকবে না। ধনীর সম্পদে দরিদ্রের ন্যায্য অংশীদারত্ব থাকবে। শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগে তার হাতে মজুরি অর্পিত হবে। মালিক ও শ্রমিক এক টেবিলে বসে খাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হবে। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার জন্য লাইসেন্স লাগবে না, মিথ্যা না বলে যত খুশি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা করা যাবে। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের আঞ্চলিক সংস্কৃতি অপরিবর্তিত থাকবে, সঙ্গীত, নাট্য, চিত্রকলায় কোনোরূপ বাধা আরোপ করা হবে না, কেবলমাত্র যা কিছু মানুষের ক্ষতির কারণ হয় সেগুলি বর্জনীয় বলে বিবেচিত হবে। আমরা বলি না যে, আপনারা আল্লাহ বিশ্বাসী হয়ে যান, মো’মেন হয়ে যান, পরকালে বিশ্বাসী হয়ে যান। আল্লাহর প্রতি কে ঈমান আনবে কে আনবে না সেটা তারা আল্লাহর সঙ্গে বুঝবে। সুতরাং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করানো আমাদের কাজ নয়, আমাদের কাজ আল্লাহর শেষ রসুলের আনীত আকাশের মতো উদার, সমুদ্রের মতো বিশাল, দুর্দান্ত গতিশীল ইসলামকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করে মানবজাতিকে শান্তিময়, নিরাপদ, ন্যায় ও সুবিচারে পূর্ণ একটি জীবন উপহার দেওয়া। দল, মত, পথ, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, আস্তিক, নাস্তিক নির্বিশেষে সকল মনুষ্য সন্তানের প্রতি আমাদের একটিই প্রশ্ন, আপনি মানবজাতির সার্বিক জীবনে সুখ, শান্তি, উন্নতি, প্রগতি ও ন্যায় চান কি না। যদি চান, তাহলে অন্য কারও কথায় প্রভাবিত না হয়ে জানুন আমরা কী বলি।
(আংশিক সম্পাদিত)
লেখক: রিয়াদুল হাসান,
দৈনিক বজ্রশক্তির সাহিত্য্য বিষয়ক সম্পাদক ও হেযবুত তওহীদের সদস্য।
0 comments:
Post a Comment