ভালোবাসা প্রকাশের লক্ষ্যে দিবস উদযাপন ও আমরা বাঙ্গালি
পৃথিবীতে বোধহয়
আমরাই একটা জাতি, যে জাতি বিশ্বের বুকে মাথা
উঁচু করে বলতে পারে-
পারিবারিক ভালোবাসা,
সুসম্পর্ক ইত্যাদি প্রকাশ করার জন্য স্পেশাল কোনো দিবস বা উপলক্ষ্যের প্রয়োজন নেই ।
কারণ বছরের প্রায়
প্রতিটা দিনেই সকাল থেকে ঘুমের আগ পর্যন্ত-
এখানকার সন্তানেরা
মা-বাবার অকৃত্রিম আদর-স্নেহে থাকে । মায়ের বকুনি, বাবার শাসন, বড় আপুর আদর, ভাইয়ার
দুষ্টুমি লেগেই থাকে । মায়ের ঘুম পাড়ানি গান শুনে আমরা ঘুমোতে যাই আবার মায়ের ডাকেই
জেগে উঠি সকালে । আমাদের বাবাগুলো অন্যরকম ভালোবাসেন আমাদেরকে । ক্ষেতখামার,ব্যবসা,অফিস
থেকে ক্লান্তি হয়ে ফেরার পরেও পরম আদরে আমাদেরকে কোলে তুলে নিয়ে বলে, আমার মা, আমার
বাবা ! হাতে একটা খাবারের প্যাকেট ধরে দিয়ে যখন কপালে-মুখে চুমু দেয় তখন মনে হয়, এরচেয়ে
সুখকর কিছু থাকতে পারেনা ।
স্কুল-কলেজের
ছুটি পেলেই আমরা দাদা-দাদী, নানা-নানী, মামা-মামীর বাসায় বেড়াতে যাই । মামাতো-খালাতো
ভাইবোনগুলোর সাথে আড্ডা, হৈ-হুল্লোড়, দুষ্টুমিতে মেতে থাকি ।দাদা-দাদী, নানা-নানী আমাদের
অন্যরকম বন্ধু । খুব মজা করি তাঁদের সাথে ।
শেষ বয়সে নাতি-নাতনীদের নিয়ে তাঁরা জীবনের শেষ দিনগুলো বেশ আরাম আর সুখ-স্বচ্ছন্দ্যেই
কাটিয়ে দেয় । আমরাই একটা জাতি, যে জাতির সন্তানেরা বড় হয়েও তার মা, বোন, ভাবি’র কাছে টাকা চাইতে
লজ্জাবোধ করিনা ।
সম্পর্কের বাঁধনে
এভাবেই আটকা পড়ে পারিবারিক শৃঙ্খলায় গড়ে উঠে এখানকার প্রত্যেকটা সুখী পরিবার । ভালোবাসা
মিশে থাকে জীবনের পরতে পরতে । আমাদের ভালোবাসা প্রকাশের গল্পগুলো ব্যতিক্রম, অকৃত্রিম
। মা-বাবা, পরিবার পরিজনের ভালোবাসা তো সর্বদাই লেগে আছে । কিন্তু মায়ের প্রতি সন্তানের
ভালোবাসা, বাবার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা, বড় আপুর প্রতি ছোট ভাই বা বোনোর ভালোবাসা,
বড় ভাইয়ের প্রতি ছোট ভাই বা বোনের ভালোবাসাগুলো প্রকাশ পায় গোপনে এবং প্রতিনিয়ত ।
অথচ বর্তমান সভ্যতার
অন্যতম ধারক ও বাহক, উন্নতির মানদন্ড নির্ণায়ক জাতিগুলোর মাঝে এই পারিবারিক শৃঙ্খলা,
সুসম্পর্কের অবস্থান একেবারেই বিপরীত । লাগামহীন যান্ত্রিক সভ্যতায় তারা এতো পরিমাণ
সম্পৃক্ত, যার কারণে তাদের চিন্তা-চেতনা, মনমস্তিষ্কে বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, একমাত্র
অর্থনৈতিক উন্নতিই সার্বিক উন্নয়নের মানদন্ড । সময় তাদের কাছে এতোই বেশি মূল্যবান হয়ে
গেছে যে, সন্তানের দেখভাল করার সময়টুকুন পর্যন্ত নেই । অফিস করার আগে ডে-কেয়ারে ছোট
ছোট বাচ্চাগুলোকে রেখে সারাদিন অফিস করার পর বাসায় ফেরার পথে সঙ্গে করে নিয়ে আসে ।
বাসায় এসে এতোটুকুন সময় নষ্ট করতে তারা রাজি নন । কাজের ব্যস্ততায় অনেক মা তার সন্তানকে
কেয়ারটেকারের কাছে রেখে আবারও বিভিন্ন কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন । ফলে সেই শিশুটি বড়ই
হয় তার মায়ের ভালোবাসা ছাড়াই । মায়ের বুকের দুধ তারা খুব কমই পায় । মা কী জিনিস, মায়ের
ভালোবাসা কেমন সেটা তারা কখনই উপলব্ধি করতে পারেনা ।
বাবা সারা দিনরাত
ব্যবসা-বাণিজ্য, পার্টি-বার, আড্ডায় ব্যস্ত থাকে । মায়ের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা । মাসের
বেশিরভাগ দিনগুলোতে স্বামী-স্ত্রী একই বিছানায় থাকেনা । তার বদলে রাত কাটায় কথিত গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ডের
সাথে । ভোগবাদী দেহসর্বস্ব এরকম একটা জীবনব্যবস্থায় তারা অভ্যস্ত । সন্তান যখন একটু
বড় হয় তখন সে নিজের চোখেই এসব দেখে তাদের কেউ সেই লাইফস্টাইলে অভ্যস্ত হয়ে সেই ঐতিহ্য
পরবর্তী প্রজন্মে নিয়ে যায়, অনেকে আবার অভ্যস্ত হতে না পেরে মনের ভিতর চরম ঘৃণা-বিদ্বেষ
নিয়ে বড় হয়ে অনেক অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে । জড়বাদী সভ্যতায় প্রতিযোগী মনোভাবে বড় হওয়া পরিবারের
ভাইবোনগুলোর মাঝেও তেমন কোনো ভালো সম্পর্ক থাকেনা । উঠতি বয়সে ছেলেমেয়েরা জীবনকে বুঝে
নিতে একরকম বাধ্য হয় । পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্যত্র স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু
করে । মা-বাবার ভালোবাসাহীন এই সন্তানটি যুবক বয়সে নারী-গাড়ি-বাড়ি-পণ্য ভোগ করার মাঝে
নিজেকে সর্বদা ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করে । তার বিকল্প নেই । কারণ পরিবারের ভালোবাসা
কী জিনিস সেটা তার জানা নেই । যেটুকুন সময় সে একা থাকে তাকে একাকীত্ব পেয়ে বসে । সেখানেও
নিজের সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকা । অ্যালকোহলের পানি দিয়ে সেই একাকীত্ব ঘুঁচানোর চেষ্টা । যখন যৌবন ফুরিয়ে যায়, শক্তি ফুরিয়ে যায় এই মানুষটি
শেষ জীবনে চরম দুঃখ-কষ্ট আর একাকীত্বের মাঝে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বেঁচে থাকার চেষ্টা
করে । জীবনটা তখন তার কাছে বিরাট প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়ায় । জীবনের অর্থ কী? কিন্তু সর্বোপরি
মানুষ হওয়াই মানবিক চাহিদার কারণেই হোক আর অন্য কারণেই হোক, মা-বাবার ভালোবাসার প্রতি
দুর্বোধ্য চাহিদা, দুর্নিবার আকর্ষণ কখনই ভুলতে পারেনা । কোনো কিছুই সেই ভালোবাসার
ঘাটতি পূরণ করতে পারেনা । তাই জড়বাদী, যান্ত্রিক এই জীবনে অন্তত একটা দিনে মায়ের প্রতি
ভালোবাসা, বাবার প্রতি ভালোবাসা, সন্তানের প্রতি বাবা-মার ভালোবাসা প্রকাশ করার ব্যাকুল
আকাঙ্খা, ইচ্ছাই বিশ্ব মা দিবস, বাবা দিবস, ভ্যালেন্টাইনস দিবসের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার
অন্যতম কারণ । যান্ত্রিক ও ব্যস্তময় জীবনে এতোটুকুনই সময় মিলে ভালোবাসা প্রদর্শণের
।
মানুষ হয়েও জীবনের
দুরকম গল্প, একই ক্যানভাস হয়েও দুরকম ছবি । এখানেই সবার সাথে আমাদের ফারাক । কারণ আমরা
বাঙ্গালি আবহমান থেকেই পরিবারে বিশ্বাসী কিন্তু দেহসর্বস্ব নই । আমরা আনন্দ-বেদনা উপভোগ
করি কিন্তু ভোগবাদী নই । আমরা সেক্যুলার কিন্তু আত্মাহীন নই । আমাদের জীবনে দুঃখ-কষ্ট
আছে কিন্তু আমরা জড়বাদী নই । জড়বাদী জাতিগুলো মায়ের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করার জন্য
বিশ্ব মা দিবস কিংবা বাবার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করার জন্য বিশ্ব বাবা দিবস, প্রেমীর
প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করার জন্য বিশ্ব ভ্যালেন্টাইনস দিবস পালন করে দায়িত্ব ও কর্তব্য
সম্পন্ন করে কৃত্রিম ভালোবাসা প্রদর্শনের চেষ্টা করে আর আমরা সারাজীবন তাদেরকে ভালোবেসে
মনে মনে বলি, ‘মাগো, ও বাবা, আজও তোমাদেরকে ভালোবাসতে পারলাম না । তোমাদের ঋণ কখনোই
শোধ করতে পারবোনা ।’
তোমরা যখন ঘটা
করে মেসেজ-ইমেইল পাঠিয়ে, ভয়েস কল দিয়ে, কার্ড দিয়ে অথবা সরাসরি মায়ের কাছে কিংবা বাবার
কাছে গিয়ে বলছো, ভালোবাসি তোমাকে খুব; তখনও আমি বলবো আমি কখনই এটি বলতে পারিনি । বলতেও
চাই না । কারণ প্রতিটি ক্ষণই আমার ভালোবাসা মিশে থাকুক আমার মায়ের প্রতি, আমার বাবার
প্রতি, স্ত্রীর প্রতি আমার পরিবারের প্রতি । ভালোবাসা প্রদর্শণের জন্য বিশেষ উপলক্ষ্য
লাগেনা, দিবস লাগেনা, বিশেষ দিনক্ষণ লাগেনা । আমি এখনও ওদের মতো যান্ত্রিক হয়ে যাই
নি যে, মায়ের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শণের সময় আমার নেই ।
আমার একদিনের
ভালোবাসা প্রদর্শণ যেনো তাঁদেরকে ছোট না করে । আমার মা, আমার বাবা, আমার প্রিয়জনেরা
বেঁচে থাকুক সবসময় আমাতে ।
- ইলিয়াস আহমেদ
0 comments:
Post a Comment